গ্যালাক্সি ও ছায়াপথ কাকে বলে এবং এদের মধ্যে পার্থক্য

 মহাবিশ্ব সম্পর্কে যাদের আগ্রহ বেশি তাদের অনেকেরই সাধারণ প্রশ্ন হচ্ছে গ্যালাক্সি ও ছায়াপথ কাকে বলে ?এবং এদের মধ্যে পার্থক্য কি? এখন অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যান যে গ্যালাক্সি ও ছায়াপথ কি একই নাকি ভিন্ন ভিন্ন। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ভূমিকাঃ

সমগ্র সৃষ্টি জগত সম্পর্কে চিন্তা করতে চাইলে ছায়াপথের প্রাথমিক তথ্যগুলো আমাদের অবশ্যই জানা প্রয়োজন। ছায়াপথ আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক অনেক গুন বড় ।মানুষ সূর্যের প্রকৃত আকৃতি ও কল্পনা করতে পারে না। অথচ সূর্য একটি ছায়া পথের তুলনায় নিতান্তই অনু পরমানুর সমান।

আমাদের সূর্যের চেয়েও বহু বড় অসংখ্য তারকা নক্ষত্র নিহারিকা সৌরজগৎ এবং মহাজাগতিক বস্তুর সমন্বয়ে ছায়াপথ গড়ে ওঠে। একটি আদর্শ ছায়াপথে এক কোটি থেকে এক লক্ষ কোটি তারকা থাকতে পারে। মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করতে আলোকবর্ষ ব্যবহার করা হয়। এক বছরে আলো যত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে সেটাই হলো এক আলোকবর্ষ।

 এক আলোকবর্ষ সমান ৯.৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটার। অর্থাৎ আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। সেই হিসেবে ছায়াপথের ব্যাস কয়েক বছর থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।

ছায়াপথ ও গ্যালাক্সি কাকে বলে?

গ্যালাক্সি শব্দটি গ্রিক ভাষার গালাক্সিয়াস(Γαλαξίας) থেকে এসেছে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার সর্বপ্রথম ১৭৮০ সালে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেন। মূলত ছায়াপথ হল মহাকর্ষ শক্তি দ্বারা আবদ্ধ একটি অতি বৃহৎ সুশৃংখল ব্যবস্থা যা তারা, আন্তঃ নক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু দ্বারা গঠিত।

গ্যালাক্সি কাকে বলে সেটা জানতে হলে প্রথমে আপনাকে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখতে হবে, না হলে এই বিশাল বিশাল গ্যালাক্সির সম্পর্কে বুঝতে পারবেন না। প্রথমেই জানতে হবে সৌরজগত বা সোলার সিস্টেম কি? 

সৌরজগৎ বলতে যেটি বোঝাই সেটি হল একটি সূর্যকে বা নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে যতগুলো গ্রহ নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে এবং এই সকল গ্রহের কিছু উপগ্রহ থাকতে পারে এই সব কিছুই এই নক্ষত্র বা সূর্যের মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে বেড়াই। তাই এই সকল গ্রহ ও উপগ্রহকে এই সূর্যের পরিবার বা সোলার সিস্টেম বা সৌরজগৎ বলা হয়। 

আরো পড়ুনঃ পৃথিবী কোন গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত?

তবে সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহ ছাড়াও ছোট বড় অনেক পাথরের খন্ড ধূলিকণা ও গ্যাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায। ঠিক এইরকম ভাবে কোটি কোটি নক্ষত্রকে ঘিরে রয়েছে তাদের গ্রহ ও উপগ্রহ বা সেই নক্ষত্রের বা সূর্যের পরিবার। বিশাল জায়গা জুড়ে একটি আকার ধারণ করে একে বলে গ্যালাক্সি।

 বিজ্ঞানের ভাষায় গ্যালাক্সি হল মহাকর্ষ দ্বারা একত্রে ধারণ করা নক্ষত্র বা অন্যান্য বস্তুর দল । মহাবিশ্বে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছায়াপথেই অতি বৃহৎ ব্ল্যাকহোল (কৃষ্ণ গহ্বর) বিদ্যমান রয়েছে এবং প্রত্যেকটি সুন্দর সুন্দর কাঠামো বর্তমান। একটি অন্যটির থেকে হাজার বা কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

 কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন থেকে সর্বোচ্চ ১০০ ট্রিলিয়ন তারা থাকে। যেখানে অগণিত গ্রহ, নীহারিকা, ধুলা, ধুমকেতু্ল্কা, ইত্যাদি মজুদ থাকে। ছায়াপথের ৯০ ভাগ ভরের জন্য দায়ী করা হয় অদৃশ্য বস্তুকে যা সম্পর্কে এখনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই বিজ্ঞানীদের। অধিকাংশ ছায়াপথের ব্যাস কয়েকশ আলোকবর্ষ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত হয়।

 একটি ছায়াপথ থেকে অন্যটির মধ্যবর্তী দূরত্ব মিলিয়ন আলোকবর্ষ হয়ে থাকে। যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী ছায়াপথ অ্যাড্রোমিডা ছায়াপথ আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথ থেকে ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ আপনি যদি আলোর গতিতে ও ছোটেন(প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে) আপনার 2.5 মিলিয়ন বছর লাগবে অ্যান্ড্রোমিডাতে পৌঁছাতে।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কি?

সংস্কৃততে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে আকাশগঙ্গা নাম দেওয়া হয়েছে।  যাকে আমরা ইংরেজিতে Ganges of the Heaven নামেও জেনে থাকি।খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ থেকে ৩২২ অ্যারিস্টোটল তার Meteorologica নামক গ্রন্থে এনাক্সগোরাস ও ডেমোক্রিটাস নামক দুইজন গ্রীক ফিলোসফার সম্পর্কে বলেন। তিনি সর্বপ্রথম আমাদের দি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির খোঁজ করেন।

আরো পড়ুনঃ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সম্পর্কে কিছু তথ্য

এই দুই ফিলোসফার এর অনুযায়ী দি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দূরে অবস্থিত অসংখ্য তারার এক সমষ্টি। কিন্তু অ্যারিস্টোটলের এই দাবির অনেক পরে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও গ্যালিলি সর্বপ্রথম গ্যালাক্সি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে সক্ষম হন। তিনি নিজের টেলিস্কোপের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করেন।

পৃথিবী কোন গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্তঃ

অনেকের মনে হতে পারে আমাদের পৃথিবী কোন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অন্তর্ভুক্ত।মহাবিশ্বে অসংখ্য ছায়াপথের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে আমাদের পৃথিবী মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের অন্তর্ভুক্ত। শুধু পৃথিবী না আমাদের সৌরজগৎ এর প্রত্যেকটি গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্রও মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের অন্তর্ভুক্ত।
১৯২০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পুরো ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি মাত্র গ্যালাক্সি। যেখানে সমস্ত নক্ষত্র অবস্থান করছে। কিন্তু ১৯২০ সালের পর এডউইন হাবাল 2.5 M(in) Hooker টেলিস্কোপের সাহায্য নিয়ে বলেন যে, পুরো ব্রহ্মাণ্ডে একটি গ্যালাক্সি নয় বরং লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি অস্তিত্ব রয়েছে।

 আর এইসব গ্যালাক্সির মধ্যেই একটি হল আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। অনুমান করা হয় দি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ডায়ামিটার প্রায় ১০০০০০ থেকে ১৮০০০০ আলোকবর্ষ(লাইট ইয়ার)। আর আর এই গ্যালাক্সি এতটাই বড় যেখানে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের অস্তিত্ব আছে। এছাড়া ১০০ মিলিয়নের থেকে বেশি প্লানেট মিল্কি ওয়েতে থাকতে পারে।

 আমাদের সৌরমন্ডল এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গ্যালাক্টিক সেন্টার থেকে ২৬০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আর গ্যালাক্টিক সেন্টার এর সাপেক্ষে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে প্রতি ঘন্টায় ৫১৪০০০ মাইল ঘুরতে থাকে। এত দ্রুত বেগে পরিক্রমন করা সত্ত্বেও আমাদের সৌরমন্ডল দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কে একবার ঘুরে আসতে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন বছর সময় নিয়ে নেয়।

 আমরা রাতের আকাশে খালি চোখে যত নক্ষত্র দেখতে পাই তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নক্ষত্রই আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত। যার মধ্যে ০.০০০০০২৫% আমরা দেখতে পাই। এইসব বড় বড় নক্ষত্রের সাথে গ্যাস ডাস্ট এছাড়া বিভিন্ন পদার্থ মিলেমিশে একটি গ্রাভিটেশন পুলের দ্বারা দি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে।

 পুরো ব্রহ্মাণ্ডে কয়েক লক্ষ কোটি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব রয়েছে। এই বিশাল গ্যালাক্সিতে যে নক্ষত্র গুলি পরিক্রমণ করছে তারা যদি এই গ্যালাক্সির বাইরে যেতে চাই তাহলে গ্যালাক্সিতে আগে থেকে ঘুরতে থাকা অবজেক্ট যেগুলি প্রায় ৬০০০০০ মাইল/ঘন্টা গতিতে ঘুরছে তার থেকেও ১০০০০০০মাইল/ঘন্টার গতিতে বেশি ঘুরতে হবে।

 বৈজ্ঞানিকেরা আজ পর্যন্ত প্রায় 18 টি এমন নিম্নক্ষত্র চিহ্নিত করেছে যারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে চলে গেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা এটা জানতে পারেনি যে এইসব নক্ষত্র গুলি এত এনার্জি কোথা থেকে এবং কিভাবে পেয়েছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিজে ১৬৮মাইল প্রতি/সেকেন্ড গতিতে ঘুরছে।

 এখান থেকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এখন আপনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন মানে আমাদের পৃথিবী যে জায়গায় আছে এক ঘন্টা পরে সেই জায়গা থেকে ৬ লক্ষ মাইল দূরে চলে যাবে। বৈজ্ঞানিকেরা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এবং এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির মত আরো গ্যালাক্সি কে লোকাল গ্রুপের অংশ মনে করেন। 

এই সব গ্যালাক্সি একটি সাময়িক মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে একসাথে টিকে আছে।বৈজ্ঞানিকদের মত অনুসারে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে। যাকে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বলা হয়ে থাকে। এই ব্ল্যাকহোলকে বিজ্ঞানীরা Sagittarius A* নাম দিয়েছেন। 

বিজ্ঞানরে অনুমান করছেন যে আগামী চার বিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এবং প্রতিবেশী গ্যালাক্সি এন্ড্রোমিডার মধ্যে একটি ভয়ানক সংঘর্ষ হতে পারে। যেটি ৫.৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত চলতে পারে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সম্পর্কে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া তথ্য বলি খুবই সামান্য বলে মনে করা হয়। কারণ আমাদের মিলকে রাখি সম্পর্কে আরো তথ্য পেতে এখনো অনেক বাকি আছে।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ

  •  মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি স্পাইরাল ডিজ বা থালার মত দেখতে, যেটি লক্ষ কোটি ইন্ডিভিজুয়াল নক্ষত্র নিয়ে গঠিত।
  • এই গ্যালাক্সির মধ্যে যে নক্ষত্রটি সবচেয়ে বেশি পুরনো অনুমান করা হয় তার বয়স 13.7 গিগাইয়ার অর্থাৎ ১৩৭০০০০০ কোটি বছর।
  • অনুমান করা হয় এই গ্যালাক্সি বিগ ব্যাং এর দ্বারা গঠিত হয়েছিল।
  •  আমাদের সৌরমন্ডল সম্পূর্ণ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কে পরিক্রমণ করছে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৫১৪০০০ মাইল বেগে। আর এই বেগে আমাদের সৌরমন্ডল পুরো গ্যালাক্সিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর সময় নিয়ে নেয়।
  •  যখন আমাদের সৌরমণ্ডল এই গ্যালাক্সিকে সম্পূর্ণরূপে একবার প্রদক্ষিণ করে তখন তাকে বলা হয় ১ গ্যালাক্টিক ইয়ার(One Galactic year)। 
  • আমাদের সৌরমণ্ডল তার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ বার দি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কে পরিক্রমণ করতে পেরেছে।

লেখকের মন্তব্যঃ

আমাদের বাসস্থান পৃথিবী সৌরজগতের একটি ছোট্ট গ্রহ। আর সমগ্র সৌরজগত ছায়াপথের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। একাধিক গ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগৎ গঠিত হয় তেমনি ভাবে অসংখ্য সৌরজগতে মিলে তৈরি হয় একটি ছায়াপথ। আশা করি তথ্যগুলো অবশ্যই আপনার জ্ঞান ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করবে।

পোস্টটি আরো তথ্যবহুল করার জন্য আপনার যুক্তিযুক্ত মন্তব্য কমেন্টের মাধ্যমে জানানোর জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এবং পোস্টটি যদি ভালো লাগে তাহোলে আপনার প্রিয়জন দের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। আবারো সম্পূর্ণ পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url