বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও সীমানা

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ যা দক্ষিণা বঙ্গোপসাগরের সাথে সীমাবদ্ধ, উত্তরে ভারত, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বে মায়ানমারের সাথে সীমাবদ্ধ। প্রত্যেকটি দেশের মতো বাংলাদেশেরও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও সীমানা


বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও সীমানা

অবস্থানগত দিক থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপখ্যাত বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ২০০.৩৪ (২০ ডিগ্রি ৩৪ ইঞ্চি) উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৬০.৩৮ (২৬ ডিগ্রি ৩৮ ইঞ্চি) উত্তর অক্ষরেখা এবং ৮৮০. ০১ পূর্ব দ্রাঘিমারেখা থেকে ৯২০. ৪১ পূর্ব দ্রাঘিমারেখার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। এ দেশের বর্তমান সীমানা- উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, অরুণাচল ও আসাম রাজ্য; পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য পূর্বদক্ষিণে মিয়ানমার (বার্মা); পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এদেশের বর্তমান আয়তন প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার বা ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল। সমুদ্রতটে এটি অবস্থিত হওয়ায় এটির আয়তন পলিমাটি ও দ্বীপ তৈরি হওয়ার জন্য ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আয়তন বাড়ার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো ভারত বিভক্তির সময় বাংলাদেশের সীমা নির্দিষ্ট হয়েছিল দু'দেশের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মধ্য স্রোত বরাবর। কিছুদিন পূর্বে মায়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্র সীমানাবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের জয়ের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় সমপরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির গঠন ও বৈশিষ্ট্য

ভূপ্রকৃতি বলতে মাটির গঠনবিন্যাসকে বোঝায়। পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠের নাম ভূপৃষ্ঠ। সাধারণত পৃথিবীর কোন দেশেরই ভূপৃষ্ঠ সর্বত্র সমান নয়। কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু; আবার কোথাও দিগন্ত বিস্তৃত সমভূমি; কোথও সুউচ্চ পাহাড় বা বিস্তৃত পর্বতমালা কিংবা বিশালাকার মালভূমি। ভূপৃষ্ঠের এরূপ উঁচুউঁচু অবস্থাকে ভূপ্রকৃতি বলে।

ভূপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশ অনন্য। এদেশের ভূখণ্ড উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণপূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু। পূর্বে সামান্য উচ্চভূমি ছাড়া সমগ্র দেশ বিস্তীর্ণ সমভূমি। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য নদনদী। এত নদনদী বিধৌত ও উর্বর সমতল ভূমি পৃথিবীতে বিরল। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বলে খ্যাত।

এই বদ্বীপ অঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমিই গড়ে উঠেছে গঙ্গা-ভাগীরথী- পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র বয়ে নেমে আসা পলিমাটি দ্বারা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যতদূর জানা যায়, সাগর সরে গিয়ে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া জেগে উঠেছে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে। এই অঞ্চল তখনো ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র।

শুধু কোটালিপাড়া নয়, শতশত বছর ধরে জমে ওঠা পলিমাটিতে এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন জনপদ। আবার এই পলিমাটি জমে জমে নদীপথও অগভীর হয়েছে। কখনো দু’কুল বেয়ে উপচে পড়ছে বর্ষার জলরাশি, কখনো- বা নদীপথ সরে গিয়ে জলাভূমির সৃষ্টি হয়েছে, ভেঙে তছনছ হয়েছে বাংলার ভূভাগ।

কিন্তু তাতে ভূপ্রকৃতির মৌলিক তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। বাংলার অধিকাংশ ভূখণ্ডই অপেক্ষাকৃত নবভূমি। বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে বেশ কিছুটা প্রাচীন বা পুরাভূমিও বিদ্যমান।

ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
  1. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ বা উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্বের পর্বতমালা
  2. প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা উচ্চ সমভূমি অঞ্চল এবং
  3.  বিস্তৃত পলিমাটির সমতলভূমি বা সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি।

1. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ:

বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব ও উত্তরপূর্ব অঞ্চলে টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ অবস্থিত। দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ১২% এলাকা নিয়ে এটি বিস্তৃত। টারশিয়ারি যুগের শেষ দিকে গিরিজন আলোড়নের ফলে হিমালয় পর্বত উত্থিত হওয়ার সময় এ সকল পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে।

এসব পাহাড় ভঙ্গিল এবং বেলে পাথর, শেল পাথর ও কাদা দিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলের পাহাড়সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: ক. দক্ষিণপূর্বের পার্বত্য অঞ্চল ও খ. উত্তর ও উত্তরপূর্বের পাহাড়সমূহ।

ক. দক্ষিণপূর্বের পার্বত্য অঞ্চল সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার কিছু অংশ নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। বাংলাদেশের প্রকৃত পাহাড়ি এলাকা বলতে এই অঞ্চলকেই বুঝায়। পাহাড়গুলোর গঠনভঙ্গি ভঙ্গিল। পশ্চিম পূর্বদিকে পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদের গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিনডং বা বিজয়। এর উচ্চতা ১,২৩১ মিটার। এটি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম কেওক্রাডং এর উচ্চতা ৪,০৩৪ ফুট বা ১,২৩০ মিটার।

পর্বতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাসিতাং, মারাঙ্গা, কায়ানারাং, বিলাইছড়ি, ভাঙ্গামুরা, বাটি মইন, ধরকল, সিতা-পাহাড় প্রভৃতি। এগুলো অধিকাংশই ঘন জঙ্গলে আবৃত, মাঝে মাঝে আছে ছোটো ঝর্ণা বা ছরা। এছাড়া চট্টগ্রামের উপকূল ঘিরে আছে সীতাকুণ্ড ও চন্দ্রনাথ পাহাড়।

খ. উত্তর ও উত্তরপূর্বের পাহাড়সমূহ: ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তরপূর্বাংশ এবং হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা জেলার পাহাড়গুলো নিয়ে এই অঞ্চল। এ অঞ্চলের পাহাড়সমূহের উচ্চতা ২৪৪ মিটারের বেশি নয়।

উত্তরের পাহাড়সমূহ স্থানীয়ভাবে টিলা নামে পরিচিত। এরূপ টিলা কুমিল্লা এবং সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মাঝে গোপালগঞ্জ ও মধুকুঞ্জের কাছে দেখা যায়। এগুলোর উচ্চতা ৩০ থেকে ৯০ মিটার। এসব পাহাড়, টিলা বা উচ্চভূমি ভারতের আসাম রাজ্যের খাসিয়া, জয়ন্তিয়া ও গারো পাহাড়ের অংশবিশেষ।

2.প্লাইস্টোসিন কালের সোপানসমূহ বা উচ্চ সমভূমি অঞ্চল:

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের শতকরা প্রায় ৮ ভাগ এলাকা নিয়ে উচ্চ সমভূমি অঞ্চল গঠিত। আনুমানিক ২৫ হাজার বছর পূর্বের সময়কালকে প্লাইস্টোসিন যুগ বলা হয়) এ সময়ে মহাদেশীয় উঁচু ভূভাগের বরফ গলে পলি সঞ্চিত হয়ে এসব উঁচু সমভূমি গঠিত হয়েছিল।এগুলোর গড় উচ্চতা ১০ থেকে ১৮ মিটার। 

এগুলোকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা: ক. বরেন্দ্রভূমি: খ. মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়; ও গ. লালমাই পাহাড়

ক. বরেন্দ্রভূমি: দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও রংপুরের কিছু অংশ নিয়ে বরেন্দ্রভূমি গঠিত। এর আয়তন প্রায় ৩,৬০০ বর্গমাইল বা ৯,৩২০ বর্গকিলোমিটার। প্লাবন সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার এই অঞ্চলের মাটির গঠন প্রকৃতি অন্যান্য অঞ্চলের মাটি হতে একটু ভিন্ন প্রকৃতির।

এই অঞ্চলের মাটি গৈরিক, স্কুল ও বালুকাময়। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে নতুন পলি সঞ্চিত হয় না। তাই এই অঞ্চলের উর্বরা শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

খ. মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: এই অঞ্চল প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদ হতে বুড়িগঙ্গা নদী

পর্যন্ত বিস্তৃত। এর পূর্ব ও দক্ষিণাংশের উচ্চতা ২০০ ফুট এবং পশ্চিম দিকে ১০০ ফুট। এ অঞ্চল মূলত ভাওয়াল গড় নামে পরিচিত। এর আয়তন প্রায় ১৬ হাজার বর্গমাইল ৪১০৩ বর্গ কিলোমিটার।

এর বিস্তৃতি ময়মনসিংহ জেলার কেন্দ্র থেকে ঢাকার উত্তরাংশ পর্যন্ত এবং এ অঞ্চলের মাটি রক্তিম ও ধূসর। ময়মনসিংহের উত্তরাংশ, জয়দেবপুর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর জুড়ে আছে দীর্ঘ গজারির জঙ্গল আর এক ধার ঘেঁষে আছে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী নদী।

গ. লালমাই পাহাড়: এটি কুমিল্লার লালমাই থেকে ময়নামতী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গকিলোমিটার। এ পাহাড়ের গড় উচ্চতা ২১ মিটার। এর মাটি লালচে এবং নুড়ি, বালি ও কঙ্কর দ্বারা গঠিত।

৩. বিস্তৃত পলিমাটির সমতলভূমি বা সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি:


ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নতুন সৃষ্ট এই নিম্ন সমভূমি অঞ্চল। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমি এ অঞ্চলের আওতায় পড়ে। এর আয়তন প্রায় ১,২৪,২৬৬ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ০৯ মিটারের কম। 

এই অঞ্চল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদনদী ও এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত) বার্ষিক প্লাবনের ফলে বহুস্থানে অগভীর জলাভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো বিল ও হাওড় নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের উপকূল ভাগ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা, ফলে অসংখ্য বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী অন্যতম।

সমভূমি অঞ্চলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: (১) পশ্চিম বদ্বীপ সমভূমি যার মধ্যে কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের উত্তরাংশ অন্তর্ভুক্ত। (২) পূর্ব বদ্বীপ সমভূমি যার মধ্যে মধ্য ও দক্ষিণ ফরিদপুর এবং বরিশাল অন্তর্ভুক্ত। (৩) বদ্বীপ মোহনা বা সুন্দরবন ও দক্ষিণ পশ্চিম বরিশাল। বাংলাদেশের এ অঞ্চলের মাটি খুব উর্বর। ফলে কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ এ কতটি নদনদী রয়েছে ?

বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি নদী উপনদী সমন্বয়ে বিশ্বের অন্যতম নদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নদনদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ছড়া, আঁকাবাঁকা মৌসুমি খাড়ি, কর্দমপূর্ণ খালবিল, যথার্থ দৃষ্টিনন্দন নদনদী ও এদের উপনদী এবং শাখানদী নিয়ে বাংলাদেশের বিশাল নদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

কিছু কিছু এলাকায় যেমন বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সুন্দরবন অঞ্চলে নদীনালা এত বেশি যে, সে অঞ্চলে প্রকৃত নদীজালিকার সৃষ্টি হয়েছে। মাকড়শার জালের মতো এসব এলাকাকে বেষ্টন করে আছে অসংখ্য নদনদী। প্রবাহ দৈর্ঘ্য ও প্রবাহ পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের নদীগুলোর সমষ্টি উল্লেখযোগ্য।

 আমাজান প্রবাহের পরই মোট প্রবাহের পরিমাণের দিক থেকে পদ্মা মেঘনার স্থান। নদীগুলোর কোনটি খরস্রোতা, কোনটি পার্বত্য নদী, কোনটি শান্ত ক্ষীণকায়া উপনদী বা শাখানদী। তবে বাংলাদেশের সর্বত্র নদীগুলো সমানভাবে বণ্টিত নয়।

দেখা যায়, দেশের উত্তরভাগের উত্তরপশ্চিম দিক থেকে ক্রমান্বয়ে দক্ষিনভাগের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের নদনদীর সংখ্যা এবং আকার দুইই বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বভাগে নদ নদীর সংখ্যা বেশি।

বাংলাদেশের নদ-নদী কয় ভাগে বিভক্ত ?


ড. মুনতাসির মামুন বাংলাদেশের নদীগুলোকে মোটাদাগে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন-

(১) গঙ্গা বা পদ্মা এবং এর বদ্বীপ, (২) মেঘনা ও সুরমা প্রবাহ, (৩) ব্রহ্মপুত্রের শাখাপ্রশাখা, (৪) উত্তরবঙ্গের নদীসমূহ, (৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সংশ্লিষ্ট সমতলভূমি নদী।

১. গঙ্গা বা পদ্মা এবং এর বদ্বীপ:
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীর এ সংস্থানটি বৃহত্তর গঙ্গা নদী প্রণালির একটি অংশ। হিমালয় পর্বতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে নির্গত ভাগীরথী এবং মধ্য হিমালয়ের গুরওয়াল থেকে উৎপন্ন আলোকনন্দা নদীর মিলিত ধারা গঙ্গ্য নামধারণ করে ভারতের হরিদ্বারের নিকট সমভূমিতে পৌঁছেছে।

এ ধারা দক্ষিণপূর্ব দিকে রাজমহল পাহাড়ের পাশ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। এর পর রাজশাহী জেলায় বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত এলাকায় প্রায় ১১২ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নামে কুষ্টিয়া জেলার উত্তরপশ্চিম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

অতঃপর গোয়ালন্দের (দৌলতদিয়া) কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় পতিত হয়েছে। পদ্মার মোট দৈঘ্য ৩২৪ কি.মি.। পদ্মা বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর একটি। পদ্মার শাখানদীগুলো হলো- কুমার, মাথাভাঙা, গড়াই, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি পদ্মার শাখা নদী।


২. মেঘনা ও সুরমা:
প্রবাহ বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী মেঘনার দৈর্ঘ্য ৬৬৯ কিলোমিটার। এ নদীটির উৎপত্তি ভারতের শিলং ও মেঘালয় পাহাড়ে। নাগাল্যান্ড ও মণিপুর জলবিভাজিকার ঢালে উৎপন্ন বরাক নদী এর প্রধান উৎস। সিলেট জেলার অমলশিদে বাংলাদেশ সীমান্তে বরাক নদী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

উত্তরের শাখা সুরমা- এটি সিলেট, ছাতক ও সুনামগঞ্জ হয়ে শহরের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। আজমিরিগঞ্জের কাছে উত্তর সিলেটের সুরমা এবং হবিগঞ্জের কালনী নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। পরে এ মিলিত প্রবাহ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে।

মেঘনা ভৈরববাজারের দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে দক্ষিণপশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে এবং চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। তিতাস, গোমতী, মনু, বাউলাই মেঘনার উপনদী। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মধ্যবর্তী এলাকাটি হাওড় এলাকা। বর্ষা মৌসুমে হাওড় এলাকা গভীরভাবে প্লাবিত থাকে।


৩. ব্রহ্মপুত্রের শাখাপ্রশাখা:
ব্রহ্মপুত্র নদী তিব্বতের মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে সাংপো নামে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার মাজাহারালীতে দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে নদীর নাম হয়েছে ঐহ্মপুত্র যমুনাতবে এটি যমুনা নামে সমধিক পরিচিত।

 এর পর দেওয়ানগঞ্জের কাছে দক্ষিণপূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পতিত হয়েছে। এ নদী প্রণালির উপনদীগুলো হচ্ছে ধরলা, সুকুমার, তিস্তা, করতোয়া ও আত্রাই। করতোয়া যমুনার দীর্ঘতম উপনদী। শীতলক্ষ্যা ও বংশী যমুনার উপনদী।


৪. চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদী প্রণালি: 
চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদী প্রণালি অন্যান্য এলাকা থেকে স্বতন্ত্র। এ অঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলি। এটি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর উৎপত্তিস্থল ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়। রাঙামাটি এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটি পতেঙ্গার সন্নিকটে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

কর্ণফুলির দৈর্ঘ্য ২৭৪ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলি নদীর তীরে অবস্থিত। কাপ্তাই নামক স্থানে এ নদীর উপর বাঁধ দিয়ে দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো: ফেনী, মুহুরী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বাকখালী এবং নাফ।

এসব নদী প্রণালির মাধ্যমে প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা স্থান বা স্থাপনা, যেখানে নৌযান চলাচলকারী যাত্রী ও পণ্য ওঠানামা করা হয় তাকে নদী বন্দর বলে। আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় নৌপথ ও নদীবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

দেশের প্রায় সব বড় শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রই গড়ে উঠেছে নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে। বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ২২টি পূর্ণাঙ্গ নদীবন্দর রয়েছে। এসব বন্দরে যন্ত্রচালিত নৌযান অবতরণ এবং যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে।

বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি ?

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলো লক্ষণীয়-
  • বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ।
  • এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত এবং ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত।
  • গঠনগত দিক থেকে বাংলাদেশ টারশিয়ারি ও প্লাইস্টোন যুগের উচ্চভূমি ও পাহাড় এবং নদী বিধৌত পলল মাটি দ্বারা গঠিত প্লাবন সমভূমির সমন্বয়ে গঠিত।
  • এটি একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ছোটো-বড় অসংখ্য নদী প্রবহমান।
  • বাংলাদেশ একটি ক্রান্তীয় অঞ্চল। এর জলবায়ু মোটামুটি উষ্ণ, আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন। বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
  • বাংলাদেশের জনজীবনে নদনদীর প্রভাব অত্যন্ত বেশি।
  • বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত দ্বার।
  • নৌ যোগাযোগের সুবিধার কারণে সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দিক যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার।
  • ভূপ্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি।

মানবজাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

যেসব বৈশিষ্ট্যে ভিত্তিতে নৃগোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ করা হয় সেগুলো হলো মাথার গড়ন, মুখাকৃতি, গায়ে লোমের পরিমাণ, ঠোঁট ও নাকের গড়ন, দেহের উচ্চতা, ওজন, দাড়ি ও চুলের রং, ঘনত্ব ও গড়ন প্রকৃতি, চামড়ার রং, চোখের মণির রং ও আকৃতি, কান ইত্যাদি। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমগ্র মানবজাতিকে প্রধানত চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১। ককেশয়েড বা শ্বেতকায় (Caucasoid),
২। নিগ্রোয়েড বা কৃষ্ণকায় (Negroid),
৩। মঙ্গোলয়েড বা বাদামি বা মঙ্গোলীয় (Mongoloid) এবং
৪। অস্ট্রালয়েড বা আদি অস্ট্রেলীয় (Australoid)।

দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানবজাতির পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য

দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানবজাতির পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য নিম্নে দেওয়া হলো:

  • মাথার গড়ন: ককেশয়েড, নিগ্রো মাথা লম্বা। অস্ট্রালয়েডদের মাথার গড়ন লম্বাটে ও মাঝারি, পক্ষান্তরে মঙ্গোলীয়দের মাথা চওড়া ও গোল।
  •  মুখাকৃতি: ককেশয়েডদের মুখাকৃতি লম্বাটে ও সরু, নিগ্রোয়েডদের মুখাকৃতি লম্বাটে তবে ককেশয়েডদের মতো অতটা সরু নয়, অস্ট্রালয়েডদের মুখাকৃতি দেহের তুলনায় বড়, চোয়াল চওড়া, থুতনি ছোটো, আর মঙ্গোলয়েডদের মুখাকৃতি গোল, চওড়া ও ভাসা ভাসা সমতল ধরনের।
  •  নাকের গড়ন: ককেশয়েডদের নাক চিকন ও উঁচু, পক্ষান্তরে নিগ্রোদের, অস্ট্রালয়েডদের থ্যাবড়া ও বোঁচা, মঙ্গোলয়েডদের মধ্যমাকৃতির।
  •  চোখের রং ও গড়ন: ককেশয়েডদের চোখের রং হালকা থেকে বাদামি
  • কালো এবং চোখের মণি নীল। নিগ্রোদের, অস্ট্রালয়েডদের ও মঙ্গোলীয়দের কালো- বাদামি থেকে কালো। তবে অস্ট্রালয়েডদের অক্ষিপটের উপরের অংশ বড় এবং মঙ্গোলীয়দের চোখের পাতা একটু বেশি মোটা এবং চোখের আকার অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র।
  •  ঠোঁট: ককেশয়েডদের ঠোঁট পাতলা, মঙ্গোলীয়দের মাঝারি, নিগ্রো ও অস্ট্রালয়েডদের মোটা ও পুরু।
  •  কান: ককেশয়েডদের কান মাঝারি ধরনের লম্বা ও প্রশস্ত, নিগ্রোদের ও অস্ট্রালয়েডদের কান ছোটো ও প্রশস্ত, মঙ্গোলীয়দের কান লম্বা ও সরু।
  •  গায়ের রং: ককেশয়েডদের গায়ের রং সাদা ও সাদা-লালচে, মঙ্গোলয়েডদের বাদামি ও হলুদ ধরনের, নিগ্রো ও অস্ট্রালয়েডদের কালো।
  •  মাথার চুল: ককেশয়েডদের চুলের রং বাদামি ও সোনালি এবং চুল চিকন ও মোটা সোজা ধরনের, নিগ্রোদেরও চুল কালো থেকে কালো বাদামি, চুল মোটা ও কোঁকড়ানো, অস্ট্রালয়েডদের চুল কালো এবং পাতলা ধরনের সোজা ও কোঁকড়া, মঙ্গোলয়েডদের চুল প্রধানত কালো ও কালো বাদামি ধরনের তবে চুলগুলো মোটা ও খাড়া।
  •  গায়ের লোম: ককেশয়েডদের গায়ে লোম ও মুখে দাড়ির প্রাচুর্য রয়েছে, নিগ্রোদের ও অস্ট্রালয়েডদের গায়ে প্রচুর লোম আছে তবে মুখে দাড়ির পরিমাণ কম, মঙ্গোলয়েডদের গায়ে ও মুখে দাড়ির পরিমাণ কম।
  • উচ্চতা ও দেহের গড়ন: ককেশয়েডদের দেহের গড়ন বলিষ্ঠ, শক্তিশালী ও লম্বা, নিগ্রোদের দেহের গড়ন শক্ত ও বলিষ্ঠ, উচ্চতা মাঝারি ও লম্বা, অস্ট্রালয়েডদের দেহের গড়ন শক্ত, উচ্চতা খর্বাকৃতি ধরনের, মঙ্গোলীয়দের দেহের গড়ন বলিষ্ঠ তবে উচ্চতা মাঝারি ধরনের।

বাংলাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়-

বাংলাদেশের মানুষের বাহ্যিক দৈহিক আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় কোন বিশুদ্ধ নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায় না। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে।

এদেশের কাউকে দেখে মনে হয় সে যেন ককেশয়েড, কাউকে নিগ্রোয়েড, কাউকে মঙ্গোলয়েড, কাউকে অস্ট্রালয়েড আবার কাউকে এদের কোনোটার মধ্যেই ফেলা যায় না। ফলে বাঙালি একক কোন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মত হলো, বাঙালি একটি সংকর জাতিগোষ্ঠী।

 বিভিন্ন ধারার ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে আজকের বাঙালি জাতি।বিজ্ঞানীরা বলেন মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের পিছনে মুখ্য কারণ হলো জৈবিক। এছাড়া সামান্য কিছু ভৌগোলিক কারণও দায়ী।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী যেহেতু এই এলাকার মানুষের কোন জীবাশ্ম বা ফসিল পাওয়া যায়নি। তাই এই দেশে মানুষের বসতি কখন শুরু হয় তা জানার কোন উপায় নেই। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব সভ্যতার যেরূপ বিবর্তন ঘটেছিল ধরে নেওয়া যেতে পাত্রে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সে রকমটি ঘটেছে।

এদেশের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন ও নব্যপ্রস্তর যুগের এবং তাম্র যুগের নিদর্শন পাওয়া যায়। এসব যুগে বাংলার পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলেই মানুষ বসবাস করতো এবং ক্রমে তারা সমতলভূমিতে ছড়িয়ে যায়। বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে সকল নৃতাত্ত্বিক রক্ত ধারা এসে মিশেছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

বাংলায় আগত জনগোষ্ঠী কে কয় ভাগে ভাগ করা হয়?

বাংলায় আগত জনগোষ্ঠীকে সাধারণত দু'ভাগে ভাগ করা যায়। 
  • প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী এবং
  •  আর্য নরগোষ্ঠী।
ক. আর্য নরগোষ্ঠী (Aryan):
আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগোষ্ঠী। তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে। উত্তর ভারতের গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করে আর্যরা ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদেশে আর্যরা বৈদিক সভ্যতার জন্ম দেয়। লম্বা মাথা, সরু ও মাঝারি নাক, গায়ের রং ফরসা, পুরুষদের দাড়ি গোঁফের প্রাধান্য এবং বলিষ্ঠ গড়ন আর্যদের প্রধান দৈহিক বৈশিষ্ট্য।

আগত অঞ্চলের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে আগত আর্যরা দুটি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল যথা- ১. আলপাইন জনগোষ্ঠী (Alpine) ও ২. নর্ডিক জনগোষ্ঠী (Nordic)। নিম্নে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. আলপাইন জনগোষ্ঠী (Alpine):
নৃতত্ত্ববিদদের মতে, খ্রিষ্ট জন্মের বহু আগে থেকেই পামির মালভূমি হতে একটি জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসবাস শুরু করে। নৃতত্ত্ববিদগণ এদের নাম দেন আলপাইন নরগোষ্ঠী। তবে এদেশের আলপাইন আর্যভাষী গোষ্ঠী ছিল ইন্দো-ইরানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

 এরা এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূল হয়ে এদেশে প্রবেশ করে। এরা মাঝারি টাইপের দৈহিক গড়নের, মাথার খুলি ছোটো ও চওড়া, নাক লম্বা, মুখ গোল ও শ্যামলা গড়নের।

২. নর্ডিক জনগোষ্ঠী (Nordic):
নর্ডিক আর্যরা সাধারণভাবে গৌরবর্ণ, লম্বা, উন্নত নাক, কপাল ও গাড় লম্বা, দেহ লম্বা ও বলিষ্ঠ। সুইডেন, নরওয়ে, উত্তর জার্মান, ব্রিটেন ও রাশিয়ার কিছু লোক এ নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এদেশে নর্ডিকরা আগমন করে উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চল থেকে।


খ. অনার্য জনগোষ্ঠী (Non-Aryan): 
আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে এদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এরা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে এসেছে। এরাই হচ্ছে বাংলার আদি জনগোষ্ঠী। অনার্য জনগোষ্ঠী আবার চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। যথা: ১. অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড, ২. নেগ্রিটো, ৩. দ্রাবিড় ও ৪. মঙ্গোলয়েড।

১. অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড: 
অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার সংলগ্ন দ্বীপসমূহ থেকে আগত আদিম অধিবাসীদের অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড বলা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, অস্ট্রিকরাই এদেশের প্রাচীনতম বাসিন্দা। বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে এ নৃগোষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অট্রিকরা পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন হয়ে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে।

এয়া ভেড্ডিড এবং নিষাদ নামেও পরিচিত। এদের গায়ের রং গাঢ় কালো, মাথার গড়ন লম্বা, নাক প্রশস্ত, উচ্চতা বেঁটে ও মধ্যমাকার। বাংলাদেশের কোল, ভীম, মুণ্ডা, সাঁওতাল, চণ্ডাল, জুয়াঙ, কোরবু প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এ পর্যায়ভুক্ত বলা যায়। এ নৃগোষ্ঠীর লোকরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত। বর্তমান মুক্ত বা মুণ্ডারী ভাষা আদি অস্ট্রিক ভাষার বিবর্তিত রূপ।

 সাঁওতাল, ভীম, জুয়াড, কোরকু প্রভৃতি উপজাতির লোক এ ভাষায় কথা বলে। কুড়ি, পণ, গণ্ডা, চোঙ্গা, ঠেঙ্গা, করাত, দা, কলা প্রভৃতি অস্ট্রিক ভাষার শব্দ।

২. নেগ্রিটো: 
নিগ্রোদের মতো দেহ গঠনযুক্ত এক আদিম জাতির এ দেশে বসবাসের কথা অনুমান করা হয়। এদের নেগ্রিটো বা নিগ্রোয়েড বলা হয়। এদের আদি নিবাস ছিল আফ্রিকা। বিশেষ করে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে এবং মেলানোশিয়ায় এরা বসবাস করতো। ঠিক কখন এরা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস শুরু করে তা জানা যায় না।

তবে এদেরকে বাংলার জনগোষ্ঠীর প্রথম স্তর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদের গায়ের রং কালো, আকার খর্বাকৃতি, ঠোঁট পুরু ও উলটানো এবং নাক খুবই চ্যাপটা। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় উপদ্বীপে নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর লোক বাস করতো বলে জানা যায়। বর্তমান সুন্দরবন, যশোরের বাঁশফোড়, ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিম্নবর্ণের জনগণের মধ্যে এদের প্রভাব লক্ষণীয়।

৩. দ্রাবিড়:
অস্ট্রিক ধাঁচের আর একটি গোষ্ঠী হলো দ্রাবিড়রা। অস্ট্রেলীয় আদিম অধিবাসীদের সাথে এদের মিল রয়েছে বলে এদেরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। এয়া ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে।

এদের দেহ মধ্যমাকার, মাথা লম্বা, নাক চওড়া, গায়ের রং কালো থেকে বাদামি, চুল কালো ও বাদামি এবং ঢেউ খেলানো। এ জনগোষ্ঠী সিন্ধুসভ্যতার স্রষ্টা। দক্ষিণ ভারতে এ গোষ্ঠীর লোকদের প্রাধান্য দেখা যায়।

৪. মঙ্গোলয়েড:
পূর্ব এশিয়ায় মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে। এককভাবে পৃথিবীতে বসবাসকারী মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর পরিমাণই অধিক। 

এ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ ও পশ্চিম চীন থেকে এদশে আগমন করে। এদের গায়ের রং পীতাভ থেকে বাদামি, বেঁটে আকৃতি, চুল কালো ও ঋজু, মাথার আকৃতি গোল, নাক চ্যাপটা, চোখের পাতা সামনের দিকে ঝোলানো। বাংলাদেশের লেপচা, ভুটিয়া, চাকমা, গারো, হাজং, মুরং, মেচ, খাসিয়া, মগ, ত্রিপুরা, মিজো, মারমা ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া পরবর্তীকালে ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায় বাণিজ্য কিংবা দেশজয়ের সুবাদে এদেশে আরও বিভিন্ন রক্তধারার লোকদের আগমন ঘটে। মধ্য এশিয়া, পারস্য, ও তুরস্ক থেকে আসা শক, তুর্কি, পাঠান, মোগল, ইরানি, আবিসিনীয়, আরব জনগোষ্ঠী এদেশে এসে বসবাস করার সুবাদে বাঙালি রক্তের সাথে তাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

পরে ইংরেজ, পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের সাথে এতদঞ্চলের মানুষের রক্তধারা মিশেছে।এভাবে দেখা যায়, বাঙালি কোন বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠীগত জাতি নয়। বাঙালি জাতি গঠনে নানা ধরনের নরগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। অস্ট্রেলীয়রাই (অস্ট্রিক) হচ্ছে এদেশের প্রথম জনগোষ্ঠী। কারো কারো মতে, নিগ্রোটোদের হটিয়ে অস্ট্রিকরা এদেশে বসবাস শুরু করে।

 এরপর দ্রাবিড়রা এদেশে আগমন করে। সভ্যতায় উন্নত বলে এরা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। ঐতিহাসিকদের মতে, দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকরা মিলে বর্তমান বাঙালি জাতির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। তার পর প্রায় এখন থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে আর্যদের দাপট পরিলক্ষিত হয়।

আর্যরা এদেশের আদিবাসী 
অনার্যদের পদানত করে এবং এদেশে বর্ণাশ্রম প্রথার সৃষ্টি করে। বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা আর্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। মঙ্গোলীয়দের একটি অংশ এদেশে বসবাস করলেও বাঙালি নরগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীব পরে আসে শক জাতির লোক পারস্য ও তুর্কিস্তান থেকে। 

তাদের রক্ত মিশ্রিত হয় এ দেশে বসবাসরত অস্ট্রিক- দ্রাবিড়-আলপাইনীয় আর্যদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এছাড়াও এতদঞ্চলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক, শাসক ও যাযাবর গোষ্ঠীর (তুর্কি, আরব, আফগান, আবিসিনীয়, ইরানি, মধ্য এশিয়ার মুঘল ইত্যাদি) আগমন ঘটেছে। তাদেরও রক্ত এদের রক্তের সাথে মিশেছে। ফলে বাঙালি হচ্ছে একটি সংকর জাতি। বর্ণ সংকরতা বাঙালিদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

বাঙালির জাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ

রিজলে তাঁর 'Tribes and Castes of Bengal' গ্রন্থে বাঙালিদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন যে, এদের অধিকাংশের মাথা গোল, নাক মধ্যমাকৃতির থেকে চওড়া, উচ্চতা মাঝারি। ড. মুনতাসির মামুন তার বই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস গ্রন্থে রিজলেকে সমর্থন করে বলেন, বাঙালির আকার মাঝারি, তবে ঝোঁক কিছুটা খাটোর দিকে, চুল কালো, চোখের মণি হালকা থেকে ঘন বাদামি, গায়ের রংও ঐ রকম, মুখ সাধারণত লম্বাটে, নাক মাঝারি। ড. মামুন আরো বলেন আদি অস্ট্রেলীয়দের দীর্ঘ মুণ্ড, প্রশস্ত নাক, মেলানিডদের দীর্ঘ ও মাঝারি নাক এবং দীর্ঘ মুণ্ড ও অ্যালপাইনদের উন্নত নাক ও গোল মুগুর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাংলার জনসমষ্টি। তবে অন্যান্য লেখক বাঙালিদের মধ্যে নিগ্রোবটু বা খর্বকায় লোকও লক্ষ করেছেন। বাঙালিদের গায়ের রং শ্যামলা, কালো ও কিছুটা পীত। বাংলাদেশের
সীমান্তবর্তী এবং পার্বত্য অঞ্চলে যেসব এথনিক সম্প্রদায় বাস করে তাদের মাথাও গোল। রিজলে এ থেকে অনুমান করেন যে বাঙালি নৃগোষ্ঠীতে মঙ্গোল প্রভাব যথেষ্ট রয়েছে। তবে তিনি তাদের গায়ের রং, নাকের গঠন, মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য ও চোখের গড়ন দেখে মত দিয়েছেন যে এদের মধ্যে দ্রাবিড় প্রভাবও বর্তমান। তার কথামতো বাঙালিরা মঙ্গোল দ্রাবিড় প্রভাবিত এক সংকর জনগোষ্ঠী। উপরের আলোচনা থেকে বর্তমান বাঙালিদের মধ্যে যে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায় তাহলো-
  • বাঙালিরা আকারে খাটো থেকে মাঝারি
  • এদের মাথার চুল অধিকাংশের কালো, কিছু বাদামি
  • চুল সোজা, তরঙ্গায়িত ও কুঞ্চিত
  • গায়ের রং কালো থেকে হালকা বাদামি
  • চোখের মণি কালো ও বাদামি
  • এদের গড়ন সম্পূর্ণ লম্বাও নয় আবার গোলও নয়
  • মধ্যম আকৃতির নাক
  • ও, এ, এবং বি গ্রুপের রক্তের প্রাধান্য।
তবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মিলনের ফলে বাঙালির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দাঁড় করানো যায় না। অর্থাৎ কোনো একক বৈশিষ্ট্য দ্বারা বাঙালিকে শনাক্ত করা অসম্ভব। কারণ একই ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক মিশ্রণের ফলে বাঙালি চরিত্রের মধ্যে বৈপরীত্য বিদ্যমান। আমাদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, আচার আচরণের মধ্যে তা ফুটে উঠেছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url