লাহোর প্রস্তাবের মূল ভিত্তি কি ছিল ?
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৭তম কাউন্সিল অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাংলার জনপ্রিয় নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।
ভূমিকাঃ
এই প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক পৃথক রাষ্ট্র (Seperate States) গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে কমপক্ষে দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল। এজন্য বলা হয়, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।
কিন্তু পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কূটকৌশলে দিল্লি কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে একটি রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেন। লাহোর প্রস্তাব পাকিস্ত ান প্রস্তাব নামেও পরিচিত। কারণ, এটি পাকিস্তান দাবির মূল ভিত্তি। এই প্রস্তাবের আলোকেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি ঘটে ও ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
লাহোর প্রস্তাবের মূল ভিত্তি কি ছিল ?
লাহোর প্রস্তাবের মূলভিত্তি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রাদেশিক ক্ষমতা নিয়ে হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এরই পরিণতিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব (Two Nation Theory) ঘোষণা করেন।
মুসলিম লীগের এ নেতার মতে, ধর্ম, সমাজ, কৃষ্টি সবকিছুতেই হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। সুতরাং তাদের আবাসভূমিও ভিন্ন হওয়া উচিত। ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্বীকার করেন, রাজনৈতিক দিক থেকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনো সাধারণ সমঝোতা নেই এবং উভয়ের উদ্দেশ্যও সম্পূর্ণ আলাদা।
এ অবস্থায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে তাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিসংবলিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে এ প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরো পূর্ব থেকে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১.মুসলিম পণ্ডিতদের চিন্তাভাবনা স্যার সৈয়দ আহমদ ও আল্লামা ইকবালসহ বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতদের লেখালেখি এবং চিন্তাভাবনা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদী মনোভাব তৈরি করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ঘোষণা করেন, ভারতে দুটি ভিন্ন জাতি বসবাস করে।
এমনকি তিনি হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেসে যোগদান করতে মুসলমানদের নিষেধ করেন। ১৯৩০ সালে আল্লামা ইকবাল এলাহাবাদে এক ভাষণে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। এজন্য আল্লামা ইকবালকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়।
১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ও ১৯৩৫ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলমানমানদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ওঠে। এভাবে মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের চিন্তাভাবনা লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি রচনা করে।
২.বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া:
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ অনুষ্ঠিত হয়।বঙ্গভঙ্গকে বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায় আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় এর তীব্র বিরোধিতা করে। এ নিয়ে তারা বিভিন্ন প্রতিবাদ এমনকি সরকারবিরোধী সশস্ত্র কার্যক্রমও পরিচালনা করে।
বিলেতি দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশি আন্দোলনের ফলে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও বঙ্গভঙ্গকে মেনে নেয়নি। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, জি. কে. গোখলে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করেন। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করে।
মূলত কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ বেনিয়াদের চাপের মুখে সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। এতে সমগ্র ভারতের মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মুসলমান সম্প্রদায় উপলব্ধি করে যে, মুসলমানদের স্বার্থ হিন্দু স্বার্থ থেকে আলাদা। এরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি রচিত হয়।
৩. মুসলিম রাজনীতির পুনর্বিন্যাস:
কংগ্রেস ও সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক চাপে এবং সর্বোপরি ব্রিটিশদের 'Divide and Rule' নীতির কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে ভারতের মুসলমানরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক মনে করল। তাদের সরকার ঘেঁষা আনুগত্যও অনেকাংশে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ব্যর্থতা প্রমাণিত হলো।
এর ফলে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব হতে সুবিধাবাদী রক্ষণশীল নেতৃত্বের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী ও উদারনৈতিক নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে। ১৯১০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগে যোগদান মুসলিম নেতৃত্বে এবং ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
এ সময় মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা জাফর আলী খান, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ মুসলিম রাজনীতির পুনর্বিন্যাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অন্যদিকে, এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে এ সময় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার জোয়ার আসে।
৪. বঙ্গভঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা:
ব্রিটিশ সরকারের কিছু কিছু কর্মকাণ্ড মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে পৃথকভাবে চিন্তা করার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করে। ব্রিটিশদের শাসন কৌশলের একটি অন্যতম নীতি ছিল, 'ডিভাইড এন্ড রম্নল পলিসি'। এ নীতির ভিত্তিতে ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের প্রথম দিকে হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে।
কিন্তু এক পর্যায়ে, বিশেষ করে সিপাহীবিদ্রোহের পর তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে তোষণ নীতি অনুসরণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে আইনসভায় মুসলমানদের জন্য পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ প্রদান করে।
আইনটি পাসের সময় লর্ড মর্লি ব্রিটিশ আইনসভার উচ্চকক্ষ লর্ড সভায় ঘোষণা করে, ভারতীয় মুসলমানরা শুধু একটি পৃথক ধর্ম অনুসরণ করে তা নয়, সামাজিক আচরণ ও জীবনযাত্রার দিক থেকে তারা একটি পৃথক জাতির সমতুল্য। সরকারের এরূপ কর্মকাণ্ড মুসলমানদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি করে।
৫. ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি:
বঙ্গভঙ্গ রদ, কানপুরের মুসলিম জনতার উপর নৃশংসতা প্রভৃতি ঘটনায় মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয় এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার মনোভাব পোষণ করে। লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলই শাসনসংস্কার দাবি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৬ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ. কে. ফজলুল হক প্রমুখের প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জন ব্লুমফিল্ড এ চুক্তিকে মুসলিম লীগের কূটনৈতিক সাফল্য (Deplomatic victory) হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পূর্বে ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টোর সংস্কার আইনে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আইনসভায় পৃথক নির্বাচনের যে অধিকার দেওয়া হয়, তা এ লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
এছাড়া মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক সত্তা কংগ্রেস কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো পরোক্ষভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের ক্ষেত্র ত্বরান্বিত করে।
৬. খিলাফত আন্দোলন:
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক স্বীয় স্বার্থে জার্মানির পক্ষ নিয়ে মিত্রশক্তির (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া) বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তুরস্কে বিদ্যমান খিলাফতের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তারা ব্রিটেনকে সাহায্য প্রদান করে এই শর্তে যে, যুদ্ধ শেষে ভারতবাসীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং তুর্কি খিলাফতের কোনো ক্ষতিসাধন করা হবে না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বিশাল তুর্কি সাম্রাজ্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এর প্রতিবাদে ১৯২০ সালে মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী এ দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমানগণ তুরস্কের খিলাফতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য 'খিলাফত আন্দোলন' এর সূত্রপাত ঘটান।
খিলাফত নেতারা ব্রিটিশ দ্রব্য ও পদবি বর্জন, আইনসভার সদস্যপদ ত্যাগ ও সরকারের সাথে অসহযোগ নীতি, এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের ডাকও দেন। এ সময় মহাত্মা গান্ধি ছিলেন কংগ্রেসের কর্ণধার। তিনি খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে একই সাথে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ইতোমধ্যে তুরস্কে মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং তিনি ১৯২৩ সালে লুজান সন্ধির মাধ্যমে তুরস্কের হৃত গৌরব অনেকটাই পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। ১৯২৪ সালে তিনি সুদীর্ঘকালের মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক 'খিলাফতের' অবসান ঘোষণা করলে খিলাফত আন্দোলনের অবসান ঘটে।
তবে আপাতঃদৃষ্টিতে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এ আন্দোলনই রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
৭. নেহরু রিপোর্ট ও জিন্নাহর চৌদ্দদফা দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুকে সভাপতি করে একটি কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশন ১৯২৮ সালে যে রিপোর্ট পেশ করে, তাতে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা করা হয়। এমনকি এতে বঙ্গ ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের সংরক্ষিত আসনের দাবিও উপেক্ষিত হয়।
ফলে এ রিপোর্ট হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টার মূলে কুঠারা ঘাত করে এবং এর পরপরই ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের দাবি সংরক্ষণ ও জাতি স্বার্থ রক্ষার্থে ঐতিহাসিক চৌদ্দদফা পেশ করেন। এর অন্যতম দফা ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য অন্যূন এক- তৃতীয়াংশ আসন রাখা।
মুসলমানদেরকে সরকারি এবং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে যোগ্যতানুযায়ী নিয়োগ করা ইত্যাদি। কিন্তু এ প্রস্তাবসমূহ হিন্দু নেতৃবৃন্দ কিছুতেই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। এর পর হিন্দু মুসলিম রাজনীতি ক্রমশ স্বতন্ত্রধারায় অগ্রসর হতে থাকে।
৮. গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা: ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক সমস্যা সমাধান, জনগণের উত্তেজনা প্রশমন ও হিন্দু মুসলমান বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ১৯৩০, ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালে এ তিনটি বৈঠক বসে।
ব্রিটিশ সরকার, ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৪৭ ৮৩ উল্লেখ্য, কংগ্রেস প্রথম ও তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করে। অন্য বৈঠকেও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের একগুঁয়েমির কারণে সম্প্রদায়গত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইনসভার প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়।
কংগ্রেস কর্তৃক মুসলমানদের ন্যূনতম দাবি মেনে না নেওয়ার কারণে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ বোধোদয় হয় যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে তারা মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
৯. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন: ১৯৩২ সালে ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো শ্রমিকদলের নেতা রামজে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। শ্রমিক দল ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে বিশ্বাসী ছিল বিধায় তারা ১৯৩২ সালে 'সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ' ঘোষণা করেন।
এর মাধ্যমে ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনাধিকারের এবং বিধান পরিষদগুলোতে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে 'ভারত শাসন আইন' প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সীমিত আকারে হলেও ভারতীয় প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়।
কিন্তু এ আইনের দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে আইনসভার সদস্যপদ বণ্টনের যে ব্যবস্থা করা হয়, তা কংগ্রেস পছন্দ করেনি। অপরদিকে, কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানগণ চিরতরে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে এবং কেন্দ্রে হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পাবে- তা মুসলমান নেতৃবৃন্দ মেনে নেয়নি।
১০. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন পরবর্তী কংগ্রেসের মুসলিম স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণ:
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে কংগ্রেস দলগতভাবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। এগারোটি প্রদেশের মধ্যে পাঁচটিতে (মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা) কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং অন্য দুটি প্রদেশে (বোম্বাই, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) সর্বাধিক আসন লাভ করে।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে (বাংলা, পাঞ্জাব ও সিন্ধু) উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করে।
তবে এসব প্রদেশে মুসলিম লীগ এককভাবে সরকার গঠনে সমর্থ ছিল না। ফলে মুসলিম লীগ যেসব প্রদেশে সর্বাধিক আসন লাভ করে সেখানে কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলেও,
কংগ্রেস হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের সাথে কোনো প্রকার আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এমনকি সরকার গঠনের পর কংগ্রেস বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণ করতে থাকে। অফিস আদালতে কংগ্রেসের দলীয় পতাকা উত্তোলন, বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দে মাতরম জাতীয় সংগীত বাধ্যতামূলক করা,
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দি চালু করা ইত্যাদি নীতি গ্রহণের ফলে মুসলমান সম্প্রদায়কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। তারা কংগ্রেস সরকারকে হিন্দুরাজ হিসেবে দেখতে শুরু করে। মূলত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের এরূপ নীতির কারণেই মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার পৃথক আবাসভূমির চিন্তা করতে বাধ্য হয়। লাহোর প্রস্তাব তারই ফসল।
১১. দ্বিজাতিতত্ত্ব:
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে কংগ্রেস এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেস যেসব প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল, সেসব প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের উপর তারা অবিচার ও নিপীড়ন চালাতে থাকে।
এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পুনরায় সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরূপ পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বহুল আলোচিত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' ঘোষণা করেন। এ তত্ত্বের দ্বারা তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এ উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান দুটি প্রধান ও স্বতন্ত্র জাতি। এদের জীবনাদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং তাদের আবাসভূমিও হবে ভিন্ন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই মূলত লাহোর প্রস্তাব রচিত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের ধারা বা বৈশিষ্ট্য
১৯৩৩ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে কবি আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান নিয়ে একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এর পর ১৯৩৭ সালে লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে ও এটা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে মুসলিম সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বিখ্যাত 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। চৌধুরী খাীলকুজ্জামান এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। অধিবেশনে তা বিপুল ভোটে পাস হয়। প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ:
"নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশনের সুচিন্তিত অভিমত এই যে,
কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনাই এ দেশে কার্যকর হবে না বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি তা নিম্নের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়। যেমন- ভৌগোলিক দিক থেকে নিকটবর্তী এলাকাসমূহের এমনভাবে অঞ্চল হিসেবে নির্দিষ্ট করতে হবে যাতে প্রয়োজনমতো এসব অঞ্চলের সীমানা রদবদল করে ভারতের উত্তরপশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু,
সে সকল অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা যায় যাদের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।" এ প্রস্তাবে আরো উল্লেখ করা হয়, "এ সকল অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শাসনসংক্রান্ত এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এবং ভারতবর্ষের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সে সকল স্থানে তাদের ও অন্যন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শাসনসংক্রান্ত ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে সংবিধানে যথোপযুক্ত কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের সুস্পষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে।
"অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৪৭ ৮৫ প্রস্তাবটি বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য বা ধারা লক্ষ করা যায়:
১. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পাশাপাশি অবস্থিত এলাকাগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
২. প্রয়োজনে এ অঞ্চলগুলোর সীমানা এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে করে ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (Independent states) প্রতিষ্ঠা করা যায়।
৩. এভাবে গঠিত রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
৪. এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে এবং ভারতের যেখানে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু সেখানেও শাসনতন্ত্রের অনুরূপ বিধানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে হবে
৫. দেশের যে কোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
বাংলার কৃতি সন্তান এ. কে. ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব মুসলিম ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখে। এ প্রস্তাবই মুসলিম লীগকে নতুন আশায় উজ্জীবিত এবং একটি নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্রমশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃতপক্ষে, লাহোর প্রস্তাবের ফলেই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তির ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা ও সংশোধন
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল একথা সত্য। তবে লাহোর প্রস্তাবের কোথাও 'পাকিস্তান' নামক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছিল ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' (states) গঠন করা হবে।
স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং বাংলাকে নিয়ে এসব স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কিন্তু একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, এই রাষ্ট্রসমূহ পৃথকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে নাকি রাষ্ট্রসমূহ একটি মাত্র ফেডারেশন ধরনের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। লাহোর প্রস্তাবের ৩ নং অনুচ্ছেদ থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না।
৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, " that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute independent states in which the constituent unit shall be autonomous and sovereign." অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত সন্নিকটস্থ অঞ্চলগুলোকে একত্র করে এমন স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা হবে যাদের ইউনিটগুলো হবে স্বয়ংশাসিত ও সার্বভৌম।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী ইউনিটগুলোকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলে তা হয় যুক্তরাষ্ট্র (Federation)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটগুলো কখনো 'সার্বভৌম' হতে পারে না। আবার ইউনিটগুলো সার্বভৌম হলে তা হবে 'রাষ্ট্র সমবায়' (Confederation)। এভাবে দেখা যায়, লাহোর প্রস্তাবের ভাষা ছিল নিতান্তই অস্পষ্ট।
এজন্য অনেকে মনে করেন, লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহের পূর্ণ স্বাধীনতা চাওয়া হয়েছিল। এ প্রস্তাবে কমপক্ষে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা লক্ষ করা যায়- একটি উত্তরপশ্চিম ভারতের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর নিয়ে অপরটি পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ ও আসামের সমন্বয়ে এবং এ দুটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশগুলো হবে সার্বভৌম।
ফলে এ প্রস্তাবের কোথাও অখণ্ড রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। একথা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও স্বীকার করেছেন। ১৯৪৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তান কথাটি আমরা চালু করিনি। হিন্দু এবং কতিপয় ব্রিটিশ প্রেসই আমাদের শব্দটি উপহার দিয়েছে।
উল্লেখ্য, লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পরপরই কতিপয় পত্রিকা এটিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করতে গিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব বলে উল্লেখ করে।লাহোর প্রস্তাবের এরূপ অস্পষ্টতা দীর্ঘদিন বজায় ছিল। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে সর্বপ্রথম 'রাষ্ট্রসমূহ' (States) কথাটি নিয়ে বিতর্ক ওঠে।
জিন্নাহ রাষ্ট্রের বহুত্ববোধক states শব্দটিকে ছাপার ভুল বলে উল্লেখ করেন এবং একটি অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। লাহোর প্রস্তাব পাসের প্রায় ছয় বছর পর উক্ত দিল্লি সম্মেলনে রাষ্ট্রসমূহ (States) এর স্থলে রাষ্ট্র (State) কথাটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু জিন্নাহ এটিকে ছাপার ভুল বলে উল্লেখ করলেও ইতিহাস সেই সাক্ষী দেয় না।
কারণ ১৯৪১ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে এবং জিন্নাহ ও গান্ধির পত্রালাপের সময়ও জিন্নাহ সাহেব রাষ্ট্রসমূহ (States) কথাটি ব্যবহার করেছেন। মুদ্রণ প্রমাদ বা ছাপার ভুল একবার হতে পারে; বারবার হতে পারে না। এমনকি মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম লাহোর প্রস্তাবের এরূপ সংশোধনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
এ দ্বারা বোঝা যায়, লাহোর প্রস্তাবের সংশোধন ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। এভাবে ভারত বিভাগের সময় ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে সুকৌশলে নস্যাৎ করা হয়।
লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব বিশ্লেষন
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস ও মুসলমানদের একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অবিভক্ত ভারতের শেষ দশকের রাজনীতিতে লাহোর প্রস্তাবই ছিল মূল নিয়ামক। এ সময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে লাহোর প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে সারা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। ড. লাল বাহাদুর এ প্রস্তাবের গুরুত্ব সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, "The Lahore Resolution was the highest culmination of Muslim aspirations roused by leaders from Syed Ahmed." ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবই ছিল মূলত পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি। লাহোর প্রস্তাবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নে এ প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. মুসলিম লীগের গুরুত্ব বৃদ্ধি: ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের আবির্ভাব ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ব্রিটিশদের সহায়তা ও মুসলমানদের দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে সংগঠনটির জন্ম হয়। উপমহাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন সংকটে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মুসলমানদের নিকট কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তুলে ধরতে পারেনি।
কিন্তু ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্ত াব উত্থাপনের মাধ্যমে দলটি ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ও লাহোর প্রস্তাবের ফলে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাতে পেয়ে এর বাস্ত বায়নে দুর্বার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
এর ফলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লীগকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়।
২।মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। কংগ্রেসের হিন্দু ঘেঁষা নীতির ফলে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেস নেতা নেহরু তার এক ভাষণে বলেছিলেন, ভারতে দুটি শক্তি একটি সরকার অন্যটি কংগ্রেস। তখন তিনি মুসলিম লীগ এবং মুসলমানদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছিলেন।
এমতাবস্থায় মুসলমানরা মনে করতো অবিভক্ত ভারত থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলে হিন্দুরাই দেশ শাসন করবে, যেখানে তাদের অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। লাহোর প্রস্তাব সেখানে মুসলমানদের নতুনভাবে আশাবাদী করে তোলে। স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে ওঠে। একথা ঠিক যে, লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কিংবা দ্বিজাতিতত্ত্বের উল্লেখ ছিল না।
আবার এটাও ঠিক জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূলভিত্তি। ফলে লাহোর প্রস্তাবই ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এক নতুন জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পরই মুসলমানদের চেতনামূলে অভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বসবাসের ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। তাই বলা যায়, লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে তীব্রভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
৩. দ্বিজাতিতত্ত্বের স্বীকৃতি: লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের তিন মাস পূর্বে ১৯৪০
সালের জানুয়ারি মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ করাচির একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় সর্বপ্রথম তার দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পর্কিত অভিমত ব্যক্ত করেন। পরে তিনি মুসলিম লীগের যে অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয় সে একই অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা করেন। যার মূল কথা ছিল, ভারতের হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। সুতরাং তাদের পৃথক আবাসভূমি থাকা দরকার।
১৯৪০ সালের মার্চ মাসের ২২ তারিখে জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা করেন আর ২৩ তারিখে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন। যদিও লাহোর প্রস্তাবের কোথাও জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের উল্লেখ ছিল না। তবু বলা যায়, দ্বিজাতিতত্ত্বই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূলভিত্তি।
মূলত লাহোর প্রস্তাব পেশের মাধ্যমেই দ্বিজাতিতত্ত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই দ্বিজাতিতত্ত্ব ও লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
৪. মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি: ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা সত্ত্বেও অধিকাংশ মুসলিম নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল।
আর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে প্রস্তাবটি ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এ সময় পাকিস্তান আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে ভারতীয় মুসলমানগণ পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়। বলা যায়, লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় মুসলমানদেরকে নতুন করে রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত করে।
৫. ১৯৪৬ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপুল বিজয়: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের ১১টি প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে মুসলিম লীগ ভালো ফলাফল করতে পারেনি। এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতেও মুসলিম লীগের ফলাফল ছিল হতাশাজনক।
অবশ্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগ ছাড়াও একাধিক মুসলিম দল ও গ্রুপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের কেন্দ্রীয় আইনসভার এবং ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগের ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রধান নির্বাচনি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে।
ফলে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ৩০টি আসনের সব কয়টি আসনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনেও মুসলিম লীগের বিরাট জয় হয়। প্রাদেশিক নির্বাচনে ৪৯২ মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল ৪২৮টি আসন। অথচ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ৪৮৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ১০৯টি আসন পেয়েছিল।
এই নির্বাচন ছিল মূলত লাহোর প্রস্তাবের পক্ষে একটি গণরায়। লাহোর প্রস্তাব ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিই মুসলিম লীগকে এই বিরাট সাফল্য এনে দিয়েছিল।
৬. পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা: লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
লাহোর প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীতে এটি পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়। কংগ্রেসে ও মহাত্মা গান্ধির তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি ছাড়া ভারতের সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
ফলে ১৯৪৭ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url