চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছরের চিকনগুনিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাই এখনই সময় চিকনগুনিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়ার।সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত চিকনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা প্রয়োজন।
চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

ভূমিকাঃ

চিকুনগুনিয়া রোগ হচ্ছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট এক ধরনের সৃষ্ট জর। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপটি ও এডিস এলবোপিকটাস এর মাধ্যমে এ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ১৯৫২ সালে তানজানিয়াতে চিকনগুনিয়া সনাক্ত করা হয়।

আর এই চিকুনগুনিয়া শব্দটি তানজানিয়ার কিমাকুন্দি ভাষা থেকে এর নামকরণ করা হয়। যার অর্থ কুচিত হওয়া বা বাঁকা হয়ে যাওয়া। চিকিৎসকদের মতে চিকনগুনিয়া ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী নয়। তবে এই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পরে এর প্রভাব রোগীর শরীরে থেকে যেতে পারে প্রায় কয়েক সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত।

চিকুনগুনিয়া কোন মরণ ব্যাধি রোগ নয়। তবে এই জ্বর হতে পারে মারাত্মক ভোগান্তির কারণ।

চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ

এমন কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখে বোঝা যাবে একজন ব্যক্তি আসলেই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত কিনা। চলুন জেনে নেয়া যাক চিকনগুনিয়া রোগের লক্ষণ গুলো কি কি
  • কোনরকম কাঁপুনি বা ঘাম ছাড়াই শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠতে পারে। এ জ্বর সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন স্থায়ী হয়, এরপর নিজে নিজে ভালো হয়ে যায়। জ্বরের সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে অসহনীয় ব্যাথা হয়।
  • গিরাই গিরায় ব্যথা ও ফুলে যায়। হাত পায়ের ছোট ছোট গিরা বা জয়েন্ট হলো প্রধানত আক্রান্ত হয়। ব্যথা সকালবেলা সাধারণত বেশি হয়।
  • ব্যথার তীব্রতা অনেকের ক্ষেত্রে এত বেশি হয় যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো এবং হাতের আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
  • অনেক সময় হাতে বা পায়ে লাল লাল দানার মত ফুসকরি বা র‍্যাস দেখা যায়। আর এই ফুসকরি বা র‍্যাস রোগের শুরুতেই দেখা যায় আবার অনেক সময় দুই তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে আবির্ভাব হয়।
  • এ সময় মাথাব্যথা হতে পারে।
  • চোখ জ্বালা করা বা চোখের পেছনে ব্যথা করা
  • গলা ব্যথা ও পেটের ব্যাথার কারণে স্বাভাবিক চলাফেরাতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
  • অবসাদ ও অনিদ্রা।
  • বমি বমি ভাব
  • ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হতে পারে।
অতএব উপরিউক্ত লক্ষণসমূহ দেখা দেওয়ার পরে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন এবং পরামর্শ গ্রহণ করুন।

চিকুনগুনিয়া রোগ কেন হয়

মূলত চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসবাহি এডিস মশার কামড়ের ফলে এই রোগটি ছড়িয়ে থাকে। এই মশা যখন কামড় দেয় তখন চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার একটি মশা যখন কোন চিকনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানোর পরে আবার অন্য কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দেয় তখন ওই ব্যক্তিও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যায়।

চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ কত দিনে প্রকাশ পায়

সাধারণত চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস মানব শরীরে বারদী পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত হওয়া ৩-৭ দিনের মধ্যেই রোগের উপসর্গ গুলো প্রকাশ পেয়ে যায়।

চিকনগুনিয়ার রোগের চিকিৎসা

চিকুনগুনি আর কোন সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক বা টিকা নেই। সাধারণত উপসর্গ দেখে যেমন জর, ব্যথা এবং র‍্যাস কমানোর জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়।

চিকনগুনিয়া হলে করণীয়ঃ

  • রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে
  • প্রচুর পরিমাণে পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
  • কুসুম গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মুছে দিতে হবে
  • জ্বরের জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল যথেষ্ট
  • গিরাই গিরায় তীব্র ব্যথার জন্য নন স্টেরয়ডাল এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অন্তত ১০ দিন পর থেকে এই ওষুধ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।তবে এসপিরিন ব্যবহার না করাই ভালো।
  • রোগীকে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। যাতে করে মশার কামড়ে এই রোগ রোগীর কাছ থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে ছড়াতে না পারে।

গর্ভাবস্থায় চিকুনগুনিয়া হলে করণীয়

গর্ভাবস্থায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় আর এ সময়ে যদি চিকুনগুনিয়া হয় তাহলে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। সেই সাথে নিতে হবে সঠিক পরিচর্যা ও পদক্ষেপ। যে গর্ভবতী মহিলার জীবন মনে হয়েছে তাকে মানসিক শক্তি রাখতে হবে যে এইটা অতটাও বেশি সিরিয়াস না এবং তাকে উপসর্গ ভেদে চিকিৎসা দিতে হবে।

গর্ভবতী মহিলাকে যথেষ্ট বিশ্রামে থাকতে হবে। বিশেষ করে তরল জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে যেমন পানি ,শরবত,জুস যাতে ডিহাইড্রেশন বা পানি শূন্যতা সৃষ্টি না হয়। অনেক সময় এরকম আক্রান্ত হলে গর্ভবতী মহিলাদের জ্বর অনেক বেশি হয়ে যায় এই সময়ে গর্ভাবস্থার জন্য প্যারাসিটামল (যেটা মা এবং শিশুর জন্য সহনশীল) গ্রহণ করতে হবে।
প্রফেসর ডাঃ নিয়াজ তাহেরা পারভিন
বিভাগীয় প্রধান, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগ
মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়

  • যেহেতু চিকনগুনিয়া প্রতিরোধে নির্দিষ্ট কোন ঠিকানায় সেক্ষেত্রে প্রথমে এডিস মশার আবাসস্থল বিনষ্ট করতে হবে। যেমন বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানিতে অ্যারিস্ট মশা বংশবিস্তার করতে পারে তাইপানিগুলো নিয়মিত দেখে শুনে পরিবর্তন করতে হবে বা ফেলে দিতে হবে।
  • যেহেতু এই ভাইরাস শুধুমাত্র মশার কামড়ে ছড়ায়, এবং এই এডিস মশা সাধারণত দিনের শুরুতে ও সন্ধ্যার পূর্বে কামড়ায়। সুতরাং এই মশা কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে মশারি, কয়েল কিংবা মশা তাড়ানোর তেল ব্যবহার করে।
  • এই জ্বরের মৃত্যুর ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক একটি রোগি এটি। এই জ্বরে ভোগান্তি হয় অনেক বেশি কিন্তু ভয়ের কোন কারণ নেই। যাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে চললে এবং নিয়ম মেনে চললে খুব তাড়াতাড়ি এই জ্বর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
  • উপসর্গ গুলো প্রকাশ পাওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হন এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে সেই মোতাবেক জীবন যাপন করুন।

ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার মধ্যে পার্থক্য

চিকনগনিয়ের লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গু জ্বরের মতো। এজন্য এই জ্বরে আক্রান্ত হওয়া মাত্রই রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে যায়। কিন্তু ভয়ের কোন কারণ নেই। কেননা এই রোগ ভোগান্তির সৃষ্টি করলেও পুরোপুরি ভালো হয়ে যায় এবং এটাতে ডেঙ্গুর মত মৃত্যু ঝুঁকি নেই বলেই চলে।

সাধারণত রক্ত পরীক্ষায় না য়া চিকনগুনিয়া ধরা পড়ে না। তবে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ডেঙ্গুর মত চিকনগুনিয়াতে প্ল্যাটিলাইট কমে যায় না। তবে রক্তে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি নির্ণয় করে চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হওয়া যায়।

লেখকের মন্তব্যঃ

সম্মানিত পাঠক উপস্থিত এই আর্টিকেলটিতে চেষ্টা করেছি চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে। চিকনগুনিয়া মরণব্যাধির রোগ নয় বলে একে একেবারে অবহেলা করা ঠিক নয়। কারণ এতে অনেক ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। তাই যদি আপনি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করুন।

আশা করি পোস্টটি পড়ে উপকৃত হয়েছে। যদি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে পোস্টটি আপনার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন কিংবা নিকট আত্মীয়র কাছে শেয়ার করতে পারে যাতে করে তারাও এই সম্পর্কে জানতে পারে।

আর যদি এই পোস্ট সম্পর্কে কোন পরামর্শ বা মতামত অথবা কোন তথ্য যোগ করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামতটি কমিটির মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন। যাতে করে অন্যরাও উপকৃত হতে পারে।

আর যদি এরকম বিভিন্ন প্রকার রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী থাকেন বা আরো অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে করতে চান তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটটিতে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।
পরিশেষে পোস্টটি সম্পন্ন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url