দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয়েছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ভয়ংকর এক বিশ্বযুদ্ধ। যাতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল। আপনি কি জানেন এ বিশ্বযুদ্ধ কবে কোথায় এবং কেন হয়েছিল? চলুন জেনে নেয়া যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয়েছিল


ভুমিকা

এমন একটা যুদ্ধ যা পৃথিবীকে ধ্বংস করা থেকে একটু দুরেই ছিল, শুধুমাত্র জমির জন্য, অন্যে দেশ দখলের জন্য মানুষ মানুষ জীবন নিয়েছিল, পরাজিত সৈন্যের উপর অমানবিক অত্যাচার করেছিল, বহু নারী তাদের সম্মান হারিয়েছিল, আর কত শিশু যেঁ অনাথ হয়েছিল তার কোন হিসাব নেই।

একটা অনুমানে বলা হয় বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৮-৯ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। এই সংখ্যা এতটাই বেশি যেঁ এত দিন ধরে পৃথিবীতে হওয়া সমস্ত যুদ্ধের মৃত্যুর সংখ্যা এক করলেও হয়ত এর কাছাকাছি আসবে না। এছারা নষ্ট হয়েছে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি, যেখানে বড়ো বড়ো শহর যুদ্ধের ছোঁয়ায় ধুলোর সাথে মিশে গেছিল।

কিন্তু কেন হয়েছিল এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ? যেঁ জার্মানি মাত্র ২০ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লজ্জাজনক ভাবে হেরে ছিল সেই জার্মানি আবার কেন অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ? চলুন আজ ইতিহাসে সব থেকে বিধ্বংসী জুদ্ধ্ব যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত তার কারন এবং এই যুদ্ধের পরনতি কি হয়েছিল তা জেনে নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয়েছিল

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন জার্মানি পোল্যান্ডে আক্রমণ করে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়েছিল। সেই সাথে তিন সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শেষ হয়েছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  কারন ও ইতিহাস

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে জার্মানির উপরে অত্যাধিক পরিমাণে ক্ষতিপূরণ চাপানো হয়,যাতে জার্মানির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এতে দেশের সাধারণ মানুষ ধার্য চরম সীমায় নেমে আসে এবং যুদ্ধের সকল ধরনের দায় জার্মানের উপর দেওয়া হয়। ফ্রান্স আন্তর্জাতিক মহলে জার্মানিকে বিভিন্নভাবে অপমান করতে শুরু করে। 

এতে করে জার্মানদের জাতীয়তা বোধে আঘাত লাগে। আর তারা এসবের প্রতিশোধের জন্য এবং এই খারাপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাউকে খুঁজছিল যে তাদের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে এনে দেবে। আর ঠিক সেই সময় উদয় হয় হিটলারের,যে তার হিংসাত্মক ভাষণের মধ্য দিয়ে জার্মানদের মন জয় করে নেয়।
এবং খুব শীঘ্রই জার্মানির একজন বড় নেতা হিসেবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন। ওদিকে জাপান তখন ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মতো উপনিবেশ তৈরির দিকে পা বাড়ায়। এজন্য তারা তাদের আর্মের শক্তি বাড়াতে থাকে। প্রথমে তারা চায়নার একটি অঞ্চল মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আর যাতে যুদ্ধ না হয় তার জন্য তৈরি হয়েছিল লিগ অফ নেশনস যেখানে জাপানের এই চায়নার দখলকৃত অঞ্চলটির বিষয়ে তুলে ধরা হয়। কিন্তু লীগ অফ নেশনস সেসময় শক্তিশালী ছিল না। তারা জাপানের উপর প্রশ্ন তুলতেই জাপান এই লীগ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

একইভাবে ইতালি ইথিওপিয়া নামে একটি দেশ দখল করে, সেখানেও লিগ অফ নেশন কোন সুরাহা করতে পারেনি। জাপান এভাবে বেশ কিছু দ্বীপ দখল করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ইউরোপের মহল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যেমনটা ছিল তেমনটাই হতে থাকে। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানের চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত হন।

তিনি ক্ষমতায় এসেই জার্মানির গণতন্ত্র শেষ করে দেন। এবং একটি দল গঠন করেন আর এ দলের বিচারধারা ছিল জার্মানরা হল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি। আর তাই এরা কমিউনিস্ট আর ইহুদিদের ঘৃণা করতো। হিটলার জার্মান বাসীদের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে,সে আবার জার্মানির পুরনো গৌরব ফিরিয়ে দেবে।

এবার সে মোতাবেক সে কাজ শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যে ভার্সাইল চুক্তি করেছিল সেই মোতাবেক জার্মানি নিজেদের আর্মির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবেনা এবং তাদের কোন এয়ারফোর্স থাকবে না। কিন্তু হিটলার ক্ষমতায় এসেই এই চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে জার্মানের আর্মি ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকেএবং শক্তিশালী একটি এয়ারফোর্স তৈরি করে ফেলে ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ঠিক হয়েছিল জার্মানের ভিতর থাকা রাইনল্যান্ড নদী জার্মান সৈন্যরা কখনো পার করতে পারবে না।এর কারণ ছিল এই নদী পার করে জার্মান সৈন্যরা যাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু হিটলার এর রাইন নদীর ধারে বহু সংখ্যক সৈন্য এবং অর্থশাস্ত্র মোতায়েন করে।

এখানেও লিগ অফ নেশনস এবং অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলো তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের চুক্তির পর্ব। জার্মানির পাশাপাশি তখন ইতালিতে ও একজন নেতার আবির্ভাব হয় তিনি ছিলেন মুসল্লীনি। হিটলার এবং মুসল্লীনির মধ্যে একটি সন্ধি হয় যেখানে তারা যুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করবে।

পরে এই চুক্তির সাথে জাপানও যুক্ত হয়। কারণ জাপান চেয়েছিল এশিয়া মহাদেশ নিজের কব্জায় করতে। আর তাদের এই কাজের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স । কারণ বৃটেন এশিয়ার বহু দেশ আগে থেকেই নিজেদের দখলে করে নিয়েছিল। ফলে জার্মানি, ইতালি এবং জাপান একজোট হয় এবং এরা অ্যাক্সিস পাওয়ার নামে পরিচিত হয়।

ওদিকে বৃটেন আর ফ্রান্সের আগে থেকেই সন্ধি ছিল ।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে ভেঙ্গে অনেকগুলো দেশ তৈরি করা হয়েছিল। যেমন চেকোস্লাবিয়া এবং পোল্যান্ড সহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। সে সময় দেশ ভাগ হলেও জাতির এবং একই ভাষার মানুষেরা আলাদা আলাদা হয়ে যায়।

ফলে তাদের মধ্যে নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবল আগ্রহ বাড়তে থাকে। যেমন পোল্যান্ডে এবং চেকোস্লামিয়াতে প্রচুর পরিমাণে জার্মানি লোক ছিল যারা চাইছিল তারা আবার যার মনের অংশ হোক। এদিকে .১৯৩৭ জাপানসালের মধ্যে জাপান চায়নার সাথে পুরো দমে যুদ্ধ শুরু করে দেয়।

সে সময় চায়নায় গৃহযুদ্ধ হচ্ছিল আর এই যুদ্ধ হচ্ছিল চীনের কমিউনিস্ট এবং ন্যাশনালিস্ট দলের মধ্যে। আর জাপান এই গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে চায়নার বহু এলাকার দখল করে নেয় এবং ওখানে গণহত্যা শুরু করে সেই সাথে সাধারণ মানুষের উপর অনেক অত্যাচার করে। এদিকের জার্মানির চ্যান্সেলর হিটলার জন্মগ্রহণ করেছিলেন অস্ট্রিয়ায়।

এবং তিনি অস্ট্রিয়াকে জার্মানির একটি অংশ মনে করতেন। কারণ ওখানে অনেক জার্মানরা বসবাস করত। ১৯৩৮ সালের ১১ মার্চ জার্মানির সৈন্য অস্ট্রিয়াকে আক্রমণ করেএবং সেখানে তেমন কোনো বাধা না পাওয়ায় তারা অস্ট্রিয়াকে জিতে যায়। বাধা না পাওয়ার কারণ ছিল এদেশের বেশিরভাগ জনসাধারণের জার্মানি দলের সমর্থক ছিল।

তবে আক্রমণের ফলেও কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। কারণ জার্মানিরা আক্রমণে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড চুপ ছিল। কারণ তারা আসলেই চাইছিল না যে অস্ট্রিয়ার এই যুদ্ধ নিয়ে আবার একটা বিশ্ব যুদ্ধ হোক। তবে হিটলার এখানেই থেমে থাকেন এরপরে একইভাবে চেকোস্লাবিয়া দখল করে নেয়। ১৯৩৯ সালের ১৫ মার্চ চেকোস্ল্যাভিয়া দখল করে জার্মানি।

এখানেও ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড কেউ কোনো রকম যুদ্ধের বিষয়ে ভাবেনি। কিন্তু সবার মৌনতাকে সমর্থন ভাবতে শুরু করে হিটলার।এরপর হিটলার রাশিয়ার সাথে সন্ধি করে তারা ঠিক করে যে তারা কখনোই একে অপরের উপর আক্রমণ করবে না। এবং তারা পোল্যান্ড দখল করবে যা একসময় জার্মানের একটি অংশ ছিল এবং পোল্যান্ডে বহু জার্মান বসবাস করত।

আর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে পোল্যান্ড দখল করার পরে তারা দু ভাগ করে নেবে এর এক ভাগ নেবে জার্মানি এবং আর এক ভাগ নিবে রাশিয়া। সেই চুক্তি মোতাবেক ১ সেপ্টেম্বর জার্মান সেনারা পোল্যান্ডের পশ্চিম দিকে আক্রমণ করে আর পূর্বদিকে রাশিয়ার সৈন্য আক্রমন করে। এদিকে পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি ছিল ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের।

ফলে তারা জার্মানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ওদিকে জাপানের সৈন্যরা ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের উপনিবেশ গুলোতে আক্রমণ করতে শুরু করেন। ব্যাস এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ।কিন্তু ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স যথেষ্ট চেষ্টা করো পোল্যান্ডকে আটকাতে পারেনি জার্মানের হাত থেকে।

 পোল্যান্ড চুক্তি মতাবেক রাশিয়া এবং জার্মানের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে যায় । আর এই যুদ্ধে কিন্তু গতি ছিল অনেক বেশি। এই যুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত ফ্রেন্ডস তৈরি করে বসে যেত না সেনারা বরং ট্রাক এরোপ্লেন ও ট্রাম্প নিয়ে গতির সাথে এগোতে থাকে এবং তারা আচমকাই আক্রমণ করত যাতে শত্রুপক্ষ কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হার মেনে যায়।

হিটলার যে কয়েক বছরের মধ্যে যার মানুষেরা দেখে এত শক্তিশালী করে তুলতে পারবে তা ভাবতে পারেনি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স। ১৯৪০ সালে জার্মান সেনারা ডেনমার্ক আক্রমণ করে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ডেনমার্ক দখল করে নেয়। এরপরে কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে নরওয়ে দখল করে তারপর রাইন নদী পেরিয়ে বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ড দখল করে নেয় জার্মান সেনা।

জার্মান সেনা এত শক্তিশালী ছিল যে মাত্র চার মাসে চারটি দেশ তারা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। এবার জার্মান সৈন্যরা এগিয়ে যায় ফ্রান্সের দিকে। তখন ইতালি যে কিনা জার্মানদের সাথে সন্ধি করেছিল তারাও এবার ফ্রান্সের ওপর হামলা করেছিল। ১০ জুন ১৯৪০ সালে জার্মান এবং ইতালি সৈন্য ফ্রান্সে আক্রমণ করে।

আর এর মাত্র চার দিনের মধ্যেই হিটলার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস দখল করে নেয়। একের পর এক হিটলার যেভাবে যুদ্ধ জিতছিল। তাতে সারা বিশ্বের মানুষ হিটলার কে ভয় পেয়ে শুরু করে কারণ তাকে কেউ আটকাতে পারছে না তখন। ফ্রান্স দখল করার পরে জার্মান এয়ারফোর্স এবার বৃটেনের উপর আক্রমণ করে।

আর এই যুদ্ধটা সম্পূর্ণ আকাশ পথে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরেকটি নৃসংসতার পরিচয় ছিল এতে সাধারণ মানুষের ওপরেও আক্রমণ করা হতো। যেমন ধরুন কোন দেশের কোথাও যদি কোন ফ্যাক্টরি থাকতো যেখানে যুদ্ধের সমগ্র তৈরি হতো সেখানেও আক্রমণ করা হতো, বোমা খেলা হত আকাশ থেকে।

কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষই কাজ করত। ফ্যাক্টরি ছাড়াও বহু শহরে আক্রমণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। জার্মানি এয়ার ফোর্স ইংল্যান্ডের বহু শহরে বোমা ফেলে এবং আক্রমণ করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ এয়ারফোর্স আক্রমণ করে জার্মান সৈন্যদের উপরে। জার্মান সৈন্য প্রায় জিতেই যাচ্ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে ব্রিটিশ এয়া ফোর্স জার্মানদের হারিয়ে দেয়।

এদিকে ১৯৪০ সাল আসতে আসতে জাপান ও ইতালির পর হাঙ্গেরি ও রোমানিয়াও যুক্ত হয় জার্মানদের সাথে। ওদিকে আফ্রিকাতেও যুদ্ধ লেগেছিল কারণ ওখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর উপনিবেশ ছিল। ১৯৪১ সালে ইতালির দখলে থাকা লিবিয়া যেখানে ইতালির সৈন্য 
ছিল তারা মিশরের উপর হামলা করে। কারণ মিশর ছিল ব্রিটিশদের দখলে।

কিন্তু সেখানে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যরা ইতালিকে পিছিয়ে দেয়। তখন আবার জার্মান সৈন্য সেখানে চলে আসে আর ই তালিকে সহযোগিতা করে। ফলে আবার ব্রিটিশরা মিশরের দিকে পিছিয়ে যায়। এ সময় জার্মান সৈন্য যুগোস্লাবিয়া এবং গ্রীসের ওপরে আক্রমণ করে দেয় ।

এ পর্যন্ত মোটামুটি হিটলার ঠিক দিকেই এগোচ্ছিল কিন্তু কথায় আছে অতিরিক্ত সাফল্য মানুষের বুদ্ধি নষ্ট করে দেয়। হিটলার হঠাৎ মনে করে সে রাশিয়া দখল করবে কারণ রাশিয়ায় অনেক চাষের জমি ছিল এবং রাশিয়া ছিল কমিউনিস্ট দেশ। আর রাশিয়া হয়তো তাদের উপর একদিন হামলা করতে পারে এইসব ভাবনা হিটলারের মাথায় তখন ঘুরতে থাকে। 

আর এতগুলো যুদ্ধ যে তারপরে হিটলার ভাবি যে তাকে আর কেউ হারাতে পারবে না। তারা ঠিক রাশিয়া জয় করে নেবে। এই ভুল ধারণা থেকেই হিটলার রাশিয়ায় আক্রমণ করার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। রাশিয়ায় আক্রমণ করার জন্য হিটলার একটি মিশন শুরু করে আর এ মিশনে ৪৫ লক্ষ সৈনিক যুক্ত হয়েছিল।

আর এই অপারেশনে ছিল ঐতিহাসিক সবচেয়ে বড় অপারেশন। জার্মান সৈন্য আচমকাই আক্রমণ করে রাশিয়ার অধীনে থাকা পোল্যান্ডকে এবং ধীরে ধীরে তারা এগোতে থাকে। প্রথমে তারা ভালই সফলতা পাচ্ছিল এবং রাশিয়ার অনেক ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে যায় তারা। 

রাশিয়ার বহু সৈন্য মারা যায় এই যুদ্ধের ফলে এবং ধরা পড়া সৈন্যদের ওপর কি পরিমান যে অত্যাচার করা হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তবে জার্মান সৈন্যরা তাদের কাজের ফল কিছুদিনের মধ্যেই পেয়েছিল। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই শীতকাল চলে আসে। জার্মান সৈন্যরা রাশিয়ার ঠান্ডায় একেবারে কাহিল হয়ে পড়ে।

 তাদের সাপ্লাই আসা বন্ধ হয়ে যায় জার্মানি থেকে।এখানে বড় বড় দুইটি ভয়ানক যুদ্ধ হয় । রাশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়া রাশিয়াকে বাঁচিয়ে দেয়। দেড়শ বছর আগে নেপোলিয়নও রাশিয়াকে আক্রমণ করেছিল কিন্তু রাশিয়ার ঠান্ডার ফলে তাদের অবস্থাও একই হয়েছিল। জার্মান সেনারা ধীরে ধীরে হারতে শুরু করে রাশিয়াতে। 

ওদিকে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের থাকা বেশ কিছু দেশ দখল করে নেয় যেমন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, বার্মা, হংকংসহ আরো বেশ কিছু দেশ ।গোটা প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে জাপানের সৈন্যরা তাণ্ডব শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ততদিনেও অংশগ্রহণ করেনি আমেরিকা। কিন্তু জাপানের শক্তি যেভাবে বাড়ছিল তাতে আমেরিকা ভয় পেয়ে যায়। 

জাপানের সৈন্যরা বহু সাপ্লাই আমেরিকা থেকে কিনতো, যেম্‌ তেল ,খাবার, অস্ত্র ও আরো অনেক কিছু। আমেরিকান সরকার তখন জাপানের এ ধরনের সাপ্লায়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ব্যান্ড লাগিয়ে জাপানের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধের ভিতর এমন আচরণে জাপান আমেরিকার উপর রেগে যায়।

 আর সে সাথে তারা ভাবতে থাকে আমেরিকা হয়তো একদিন তাদের উপর আক্রমণ করবে। জাপান ঠিক করে আমেরিকা তো আজ বা কাল আক্রমণ করবেই তার আগেই আমরা তাদের উপর আক্রমণ করে দেই। আর এখানেই জার্মানির মতো জাপানও ভুল করে।

 প্রথমে জাপানি এয়ার ফোর্স ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর আমেরিকার পালহার্ভারে থাকা আমেরিকার নেভির উপর আক্রমণ করে দেয়। আচমকা এই আক্রমণে আমেরিকার প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য মারা যায়, বহু জাহাজ বন্দরে ধ্বংস হয়ে যায়। একই দিনে তারা হাওয়াই মালয়েশিয়া হংকং সহ বহু দেশগুলোতে আকাশ থেকে বোমা ফেলে। 

আর জাপানের এই আক্রমণের সাথে সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরপর জাপান এবং আমেরিকার মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এখানে প্রশান্ত মহাসাগরের শুরু হয় ব্যাটেল অফ মি ডওয়ে যেখানে জাপানের সৈন্য আমেরিকার কাছে হেরে যায়। বলা হয় জাপানের একটি রেডিও ট্রান্সমিটার কে বিকট করে ফেলেছিল আমেরিকান নেভি।

 আর তাতেই যুদ্ধ জিতে যায় আমেরিকা। তবে তখনও পুরোপুরিভাবে জাপানকে হারাতে পারেনি আমেরিকা ১৯৪২ সাল আস্তে আস্তে জার্মানির ভাগ্য বদলাতে থাকে। জয় তাদের ভাগ্য থেকে এবার সরে যায়। রাশিয়ার উপর আক্রমণ করায় রাশিয়া আবার ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয় সেই সাথে আমেরিকাও আবার ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়। 

এভাবে গ্রীস ,ফ্রান্স সবাই আবার যুক্ত হয় এবং আবার শক্তি ফিরে পায় তারা। সেই সাথে তাদের একত্রিত জোটের নাম হয় মিত্র শক্তি। রাশিয়া জার্মান সৈন্যকে এবার পিছাতে থাকে। ওদিকে আফ্রিকাতে ১৯৪২ সালে ইতালি ও জার্মান সৈন্যরা পেছনে থাকে। কারণ ততদিনে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন আমেরিকান সৈন্য। 

এবার ইতালির দ্বীপ সিসিলি দখল করে নেয় মিত্র শক্তি। তারা এবার ইতালির উত্তর অংশে আক্রমণ করে। কিন্তু সে সময় ইতালির শাসক মুসল্লীনীকে তার দেশের কিছু নেতা বন্দী করে এবং তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়। মিত্র শক্তি দক্ষিণ ইতালিতে জিতে যায়।

১৯৪৪ সালের ভেতরে রাশিয়া ইউরোপে জার্মানির দখলে চলে যাওয়া বেশ কিছু দেশকে আবার জার্মানের থেকে ছিনিয়ে নেয়। ওদিকে মিত্র শক্তির ক্রমাগত আক্রমণে জাপানি সৈন্য এবার একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৪৪ সালের ৬ জুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ফ্রান্স প্রায় চার বছর ধরে জার্মানির দখলে ছিল। 

কিন্তু এই দিন মিত্রশক্তির সৈন্যরা ফ্রান্সের উত্তরও উপকূলে আসে এবং সেখানে জার্মান সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে। এই বিশেষ দিন যা “দি ডে”নামে পরিচিত। এই নিয়ে কিছু হলিউড সিনেমাও তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে একটি হলো “সেভিং প্রাইভেট রায়ান”। এবার মিত্র শক্তি জার্মানদের পিছিয়ে দেয় এবং তাদের পুরনো সীমানায় আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়। 

১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল জার্মানি আত্মসমর্পণ করে মিত্র শক্তির সামনে এবং এর একদিন পরে ৩০শে এপ্রিল এ বিশ্বযুদ্ধের সেই হিটলার তার স্ত্রীর সাথে বাংকারে আত্মহত্যা করে। কিন্তু জাপান তখনো যুদ্ধ হয়নি। আমেরিকা প্রথমে ঠিক করে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে কিন্তু তাতে তাদের বহু সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হবে এবং যুদ্ধ অনেকদিন ধরে হবে।

শেষে তারা ঠিক করে জাপানের ওপর পারমাণবিক হামলা করার। ৬ এবং ৯ আগস্ট তারা জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে যাতে দুটো শহর ধ্বংস হয়ে যায়। জাপানি সৈন্যের জন্য বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র তৈরির ফ্যাক্টরি ছিল। দুটো শহরে মোট প্রায়.২ লক্ষ মানুষ মারা যায় এই আক্রমণের ফলে।

এই বোমা ফেলার কয়েক দিনের মধ্যেই জাপান আত্মসমর্পণ করে। আর এর সাথে বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধ জাপান চায়না ছেড়ে দেয়। চায়না আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং সেই যুদ্ধে কমিউনিস্টরা জিতে যায়। তারপর চীনে সরকার গঠন করে তারা। এরপর জার্মানি দুই ভাগ হয়ে যায় এবং রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ভাগ হয়।

আর যুদ্ধের পরে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ যা আগামী ৪০ বছর ধরে চলতে থাকে। যুদ্ধে ভারতের প্রায় ২৫ লক্ষ সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৭৮ হাজার সৈন্য। যুদ্ধ ছাড়াও হিটলার কমিউনিস্ট , মানসিক রোগী , বিকলাঙ্গ রোগীদের হত্যা করেছিল। সেই মৃত্যের সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি।

এছাড়া যুদ্ধের সময় বাংলায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল। বাংলার খাদ্য ব্রিটিশরা পৌঁছেছিল সৈন্যদের জন্য। এর ফলে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা যায় এবং ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। তবে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই গঠিত হয়েছিল ইউনাইটেড নেশনশ বা জাতিসংঘ।

এই জাতিসংঘ প্রায় ৭০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছে এবং এখনো পর্যন্ত করে চলেছে। আর এটি অনেক সম্ভাব্য যুদ্ধকে আটকেছে। যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ফ্রান্সের ক্ষমতা অনেক কমে যায় ফলে তাদের অধীনে থাকা অনেক উপনিবেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম বারের মত বিশ্বযুদ্ধের স্বাক্ষী হয়েছিল মানব সভ্যতা। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী সেই যুদ্ধকে ঐ সময়ের প্রভাবশালীরা “সব সংঘাত বন্ধের যুদ্ধ”ও আখ্যা দিয়েছিলেন।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে এমন রক্তক্ষয়ী ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে লীগ অব নেশন্স নামক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনও গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই সংগঠনটিকে বর্তমান জাতিসংঘের পূর্বসূরী বলা যেতে পারে।তবে, ইতিহাসবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিপর্বই পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করে গিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় মাত্র দুই দশকের মধ্যেই পুরো পৃথিবীজুড়ে আবারো বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠেছিল। সংগত কারণেই এই যুদ্ধটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটি ছিল মানব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে পৃথিবীর কমপক্ষে ত্রিশটি দেশের প্রায় দশ কোটি মানুষ সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। আর যুদ্ধ শেষে সব মিলিয়ে প্রানহানির সংখ্যা ছিল সাড়ে আট কোটির বেশী। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশী ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।

আর এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাতসীদের দ্বারা নির্বিচারে ইহুদী নিধনের কার্যক্রমটি মানব ইতিহাসের অন্যতম বিষাদপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। হলোকাস্ট শীর্ষক এই জেনোসাইডে কমপক্ষে ৬০ লাখ ইহুদী ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী।

লেখকের মন্তব্য

উপরোক্ত আর্টিকেলটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যুদ্ধ কখনোই মানুষের জীবনে শান্তি বয়ে আনে না। মানুষ বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তখনই শান্তিতে থাকে যখন যুদ্ধ এড়িয়ে থাকা যায়। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত।যাতে করে আমরাও ভবিষ্যেতে এধরনের যুদ্ধ এড়াতে পারি।

সুতরাং আশা করি উপরোক্ত আর্টিকেলটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। যদি আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে এটি আপনি আপনার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন যাতে করে তারাও সম্মুখ ধারণা লাভ করতে পারে বিশ্ব যুদ্ধ সম্পর্কে।

এই পোস্ট সম্পর্কে যদি কোন মতামত প্রশ্ন কিংবা পরামর্শ থাকে তাহলে তো অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন। আর বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে, বিভিন্ন আবিষ্কার ও আবিষ্কারক সম্পর্কে , বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনের সম্পর্কে , স্বাস্থ্য সম্পর্কে ও তথ্য প্রযুক্তি

 সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে আমাদের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন। কারণে ধরনের আর্টিকেল আমাদের ওয়েবসাইট নিয়মিত প্রকাশ করা হয়ে থাকে। আর অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আছে এখানে শেষ করছি ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।

পরিশেষে আর্টিকেল সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ💚।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url