ইবনে খালদুন কত সালে জন্মগ্রহন করেন

অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মুসলিম দার্শনিক ও সমাজ চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানের আদি জনক হিসেবে সুপরিচিত। চলন জেনে নেয়া যাক তার জীবনী ও বিভিন্ন মতবাদ সম্পর্কে।
ইবনে খালদুন কত সালে জন্মগ্রহন করেন

ভূমিকা

ইবনে খালদুন বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। ইবনে খালদুন আধুনিক ইতিহাস দর্শনের ইতিহাসেও অনন্য সাধারণ এবং অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ইবনে রুশদ এর মৃত্যুর পর থেকে মুসলিম দর্শনের গতি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। ইবনে রুশদের দর্শন মানুষের মনে আবেগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।

যে কারণে তাঁর মৃত্যুর পর মুসলিম জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নেমে আসে অন্ধকার। তখন দর্শন পরিণত হয় মরমীবাদে, আর মুসলমানদের মধ্যে আবির্ভাব ঘটে বিভিন্ন দরবেশ ও সূফি সম্প্রদায়ের। নিম্নে ইবনে খালদুনের পরিচয় দেয়া হলো
আরো পড়ুনঃ অ্যারিস্টোট কত সালে জন্মগ্রহণ করেন

ইবনে খালদুন কত সালে জন্মগ্রহন করেন

ইবনে খালদুন ১৩৩২ সালের ২৭ মে উত্তর আফ্রিকার তিউনিস শহরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম 'ওলীউদ্দিন আবু জায়েদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে খালদুন আল হাযরামী।' 'ওলীউদ্দীন' হলো তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ উপাধি।

'আবু জায়েদ' হলো তাঁর ডাকনাম। ইবনে খালদুন তাঁর পারিবারিক নাম। এ নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি দক্ষিণ আরবের প্রসিদ্ধ কিন্দা গোত্রের অধিবাসী।
আরো পড়ুনঃ প্লেটো কত সালে জন্মগ্রহণ করেন

ইবনে খালদুনের শিক্ষাজীবন

ইবনে খালদুনের পিতা মুহম্মদ একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। পিতার নিকট তাঁর প্রথম হাতেখড়ি হয়। পরে তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের নিকট হতে কুরআন, তাফসীর, আইন, কলা, বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের বহুবিধ শাখায় জ্ঞানলাভ করেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ইবনে খালদুন অল্প বয়সে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন।

ইবনে খালদুনের কর্মজীবন

তাঁর প্রতিভা ও মননশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তিউনিসের সুলতান দ্বিতীয় আবু ইসহাক মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করেন। তাঁর মধ্যে ছিল অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতাশালী হওয়ার প্রবণতা। তাই তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কখনো সচিব, কখনো রাষ্ট্রদূত, কখনো বা বিচারপতির মতো মর্যাদাপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

১৩৮৪ তিনি কায়রোতে যান এবং সেখানে কাজী-উল-কুফত পদে চাকরি করেন। এর কিছুকাল আগে ১৩৮২ সালের দিকে তিনি মিশরের বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক উৎসের সন্ধানে তিনি স্পেন, ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, আরব ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন।
 তাঁর রচনা সামগ্রীর মধ্যে অমর কীর্তি হলো 'কিতাবুল ইবার' রচনা।এ গ্রন্থটি সমাজবিজ্ঞানের আদি গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড হচ্ছে মুকাদ্দিমা বা মুখবন্ধ। এখানেই তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর ইতিহাস দর্শন।সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত এখানে বর্ণনা করেছেন।

''আল মুকাদ্দমা' গ্রন্থের জন্যই তিনি সাম্প্রতিক কালে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর ইতিহাস দর্শন মানবজাতির চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর অবদান। তাঁকে মধ্যযুগীয় ইতিহাসের রোজার বেকন বলা হয়।উপর্যুক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানের আদিজনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যদিও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্টকোৎ তবুও কোৎ অনেকাংশে ইবনে খালদুনের নিকট চির ঋণী।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ইবনে খালদুনের মতবাদ

নিম্নে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ইবনে খালদুনের মতবাদটি ব্যাখ্যা করা হলো:
রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে সামাজিক সংহতি : ইবনে খালদুনের সমসাময়িক অনেক খ্রিস্টান দার্শনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে ঐশ্বরিক মতবাদের কথা বলেন।

কিন্তু ইবনে খালদুনই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সকল কাল্পনিক ও বিভ্রান্ত ধারণাকে বর্জন করে বলেন যে, মানুষের জীবনের স্বাভাবিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। তিনিই প্রথম বলেন গোত্রসংহতির বহিঃপ্রকাশ হলো রাষ্ট্র।
আরো পড়ুনঃ নাগরিকতার সম্পর্কেএরিস্টটলের মতবাদ
ইবনে খালদুন 'মুকাদ্দিমার' সূত্র ধরে চার্লস ঈশারী তাঁর 'An Arab philosophy of History' গ্রন্থে বলেন, নিজের পক্ষে শুধু যদি একদিনের জীবনযাত্রার কথা ধরা হয় তাহলেই দেখা যায় যে, এই একদিনের জন্য গমের প্রয়োজন, তা ভাঙানোর প্রয়োজন, আটা মাখানোর প্রয়োজন ও রুটি প্রস্তুতির প্রয়োজন।

আবার এসব প্রয়োজন মিটানোর জন্য বিভিন্ন বাসন কোসন ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। তার অর্থ একদিনের প্রয়োজন মিটানোর জন্য পাচক, ছুতার, কামার, কুমার, কারিগরসহ অন্যান্য পেশার লোকের কাজের প্রয়োজন। একজন লোকের পক্ষে এসব প্রয়োজন এককভাবে মিটানো সম্ভব নয়।

 সকলে যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে তবে প্রয়োজনের চেয়ে তারা অনেক বেশি কাজ করতে সক্ষম হবে।পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে খালদুন বলেন, মানুষের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজের সৃষ্টি হয়। সকল মানুষ শুধু যুক্তি ও ভালো বুদ্ধি দ্বারা পরিচালনা হয় না। কিন্তু লোক পশুসুলভ প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেয় এবং সমাজে নানা ধরনের অপকর্ম করে থাকে।

ইবনে খালদুনের গ্রন্থগুলোর তালিকা

আধুনিক সমাজবিজ্ঞান রচনায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন। তাঁর জীবনে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা তাঁর রচনার মধ্যে বহিঃপ্রকাশ করে গেছেন।নিম্নে ইবনে খালদুনের কর্মগুলো প্রদান করা হলো।
ইবনে খালদুনের গ্রন্থগুলো হচ্ছে
  • কিতাবুল ইবার,
  • বিশ্ব সাহিত্যের ভূমিকা,
  • Allaqa li-1- Sultan.
  • সুবাবুল মুহাসলার ফী-উমুলিদদিন,
  • তা-রীফ,
  • ইহাতা,
  • Lubabac 1-Muhassal.
উপর্যুক্ত গ্রন্থগুলোর অধিকাংশ কালের বিবর্তনে বিলী হয়ে গেলেও বর্তমানেও যে গ্রন্থটির জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন সেটা হলো আল মুকাদ্দিমা।ইবনে খালদুন বিশ্লেষণধর্মী ও ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসারী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের উত্থান পতন নির্দেশ করতে গিয়ে

মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতো অদৃশ্য শক্তির তেমন গুরুত্ব দেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে খালদুন একজন তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি তখনকার সময় থেকে সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি অত্যন্ত যুক্তিসংগত উপায়ে সমাজকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমার গ্রন্থর বর্ননা

ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা হলো ইতিহাসের দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের জগতে এক অনন্য সৃষ্টি। মাত্র চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে খালদুন 'মুকাদ্দিমা' নামক মূল্যবান গ্রন্থটির প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করতে সমর্থ হন। তিনি ১৩৭৮ সালে তিনি এ গ্রন্থ রচনা শেষ করেন। এটি কিতাবুল ইবার গ্রন্থের ভূমিকা।

আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থটি ছয় খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড: প্রথম খণ্ডে মানবসভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখাদ্য ভূগোল, নৃতত্ত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় জীবনের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় খণ্ডে যাযাবর ও স্থায়ীভাবে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয় খণ্ড: তৃতীয় খণ্ডে বিভিন্ন রাজবংশের শাসনপ্রণালী, তাঁদের সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের - চুলচেরা বিশ্লেষণের কথা বলা হয়েছে।

চতুর্থ খণ্ড: চতুর্থ খণ্ডে তিনি শহর ও গ্রামের জীবনের পার্থক্য আলোচনা করেছেন। খালদুনের মুকাদ্দিমার এ অংশটি ইতালির সমাজ দার্শনিক মেকিয়াভেলী রচিত "The Prince" গ্রন্থের সাথে তুলনীয়। 

পঞ্চম খণ্ড: তিনি পঞ্চম খন্ডে মানুষের জীবনযাত্রার উপায় পেশা, শিল্পকলা, ব্যবসায়বাণিজ্য, কৃষি, ঘরবাড়ি নির্মাণ,
তাঁতশিল্প, দর্জির কাজ, চিকিৎসাশাস্ত্র, কর্মচারী কর্মকর্তার দায়িত্ব ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

ষষ্ট খণ্ড: শেষ অংশে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে শিখন ও শিক্ষণ এর মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে খালদুন একজন ঐতিহাসিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং মানুষের কর্মকাণ্ডের গভীর অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিত্ব। তিনি মানবজাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উপলব্ধির জন্য অতীতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বিশেষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন।

লেখকের মন্তব্য

প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আর্টিকেলটিতে বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে খালুদুনের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়েছেন।

আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে ইবনে খালদুন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন।যদি আর্টিকেলটি পড়ে আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এটি আপনার বন্ধুবান্ধব কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন যাতে করে তারাও সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে।

আর এ পোষ্ট সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন মতামত কিংবা কোন পরামর্শ থাকে তাহলে অবশ্যই এটা কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন।এছাড়াও আপনি যদি বিজ্ঞানভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞান মূলক, বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী ও আবিষ্কার, বাংলাদেশের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কিত আর্টিকেল করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন

তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।কারণ এ ধরনের আর্টিকেল আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি। আরো অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকে এখানে শেষ করছে ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।

পরিশেষে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url