মৌলিক অধিকার কাকে বলে

স্বাধীন রাষ্ট্রের বসবাসরত সকল নাগরিক মৌলিক অধিকারের দাবিদার। তাই প্রত্যেকটা নাগরিকেরই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে জানা উচিত যাতে করে তারা তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু লাভ করতে পারে।
মৌলিক অধিকার কাকে বলে

ভূমিকা

অধিকার হলো রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত কতকগুলো বিধিবদ্ধ সুযোগ-সুবিধা, যা ব্যতীত ব্যক্তি সমাজে টিকে থাকতে পারে না এবং স্বীয় ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। মানুষের অধিকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

যেমন-নৈতিক অধিকার, আইনগত অধিকার, সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার ইত্যাদি। । এর মধ্যে কিছু অধিকার মানুষের মৌলিক বা জন্মগত।

মৌলিক অধিকার কাকে বলে

মৌলিক অধিকার হলো রাষ্ট্র প্রদত্ত সেসব সুযোগ-সুবিধা যা নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য। মৌলিক অধিকারের মাধ্যমেই জনগণ তাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। নাগরিকদের প্রতিভার বিকাশ ও জীবনের যথাযোগ্য প্রকাশের জন্য মৌলিক অধিকার অবশ্যই প্রয়োজন।গণতান্ত্রিক সমাজের মূলভিত্তি হলো মৌলিক অধিকারসমূহ।

মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবন্ধ থাকায় এগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হয় এবং তা সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। অতএব বলা যায়, মৌলিক অধিকার হচ্ছে নাগরিক জীবনের বিকাশ ও ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সেসব অপরিহার্য শর্তাবলি, যা সার্বভৌম সংবিধানে সন্নিবেশিত এবং সরকারের পক্ষে অলঙ্ঘনীয়।
মৌলিক অধিকার নাগরিকের জন্মগত অপরিহার্য অধিকার। এ অধিকার নাগরিকবৃন্দ সংবিধানের মাধ্যমে লাভ করে। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশেই জনগণের মৌলিক অধিকার বহাল থাকে। মৌলিক অধিকারের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • প্রথমতঃ মৌলিক অধিকারগুলো মানুষ জন্মগতভাবে লাভ করে।
  • দ্বিতীয়তঃ মৌলিক অধিকার সাংবিধানিকভাবেও স্বীকৃত। কেননা রাষ্ট্র সেগুলো রদ করতে পারে না, যদি না কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অংশগ্রহণ করে।
  • তৃতীয়তঃমৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কার্যকর হয়ে থাকে। অর্থাৎ নাগরিক রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে মৌলিক অধিকার লাভের অধিকারী হয়।
  • চতুর্থতঃমৌলিক অধিকার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট।
  • পঞ্চমতঃ মৌলিক অধিকার দাবি সুস্পষ্ট হওয়ায় সংবিধান হলো এর উৎস।
উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের সংবিধানের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের দলিল। ১৯৭২ সালে এই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক নাগরিক অধিকারকে খর্ব করার ক্ষমতা প্রদান করা হলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় মৌলিক অধিকারকে অলজানীয় ও বিচার বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত করা হয় এবং সেই থেকে অদ্যাবধি মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলো সাংবিধানিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে।

সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭-ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মৌলিক অধিকারের বর্ণনা রয়েছে। এতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে মানবাধিকারের সাথে বাংলাদেশের মৌলিক অধিকারের সামঞ্জস্য ঘটানো হচ্ছে।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মৌলিক অধিকার হলো নাগরিকের এমন সব অধিকার, যেগুলো কোনো রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলেই সে আপনাআপনি লাভ করে। নাগরিকের মৌলিক অধিকারে কেউ অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

তবে যুদ্ধ বা অন্য কোনো বিশেষ কারণে রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার সাময়িক স্থগিত করতে পারে।

মৌলিক অধিকার কয়টি ও কি কি

যখন কতিপয় মানবাধিকারকে কোন দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং সাংবিধানিক নিশ্চয়তা (Constitutional guarantees) দ্বারা সংরক্ষণ করা হয় তখন তাদেরকে মৌলিক অধিকার বলা হয়। মৌলিক অধিকারগুলো সবই মানবাধিকার। তবে এগুলোকে মৌলিক অধিকার বলার কারণ হলো, যেহেতু

সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন বা মৌলিক আইন এবং ঐ সংবিধানে সংযোজিত অধিকারগুলোও মৌলিক আইনের অংশ এবং এদেরকে বিশেষ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার রক্ষা করা হয়; এদেরকে পরিবর্তন করতে হলে স্বয়ং সংবিধানকে সংশোধন করতে হয়।

বাংলাদেশ সংবিধানে সুরক্ষিত মৌলিক অধিকারসমূহ

বাংলাদেশ সংবিধানে ১৮টি অধিকার সন্নিবেশ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৪ পর্যন্ত এই ১৮টি অধিকারের প্রকৃতি ও ভোগের নিশ্চয়তা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো সবই পৌর (Civil) ও রাজনৈতিক (Political) অথিকার। ১৮টি মৌলিক অধিকারকে প্রথম দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

ক. রাষ্ট্রে অবস্থানরত নাগরিক ও বিদেশী উভয়ে ভোগ করতে পারে। এরূপ মৌলিক অধিকার ৬টি। এগুলো হলো:

১. জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (অনুঃ ৩২)।

২. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ (অনুঃ ৩৩)।

৩. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ (অনুঃ ৩৪)।

৪. বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ (অনুঃ ৩৫।

৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা (অনুঃ ৪১)।

৬. সংবিধানিক প্রতিকার পাওয়ার অধিকার (অনুঃ ৪৪)।

খ.শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোগ করতে পারে- এরুপ মৌলিক অধিকার ১২টি। এগুলো হলো- ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪২ এবং ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারসমূহ।

১৮টি মৌলিক অধিকার নিম্নরুপঃ
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুঃ ২৭)
২. ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য (অনুঃ ২৮)
৩. সরকারী নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা (অনুঃ ২৯)
৪. বিদেশী খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ (অনুঃ ৩০)
৫. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুঃ ৩১)
৬. জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ (অনুঃ ৩২)
৭. গ্রেফতার আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ (অনুঃ ৩৩)
৮. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ (অনুঃ ৩৪)
৯. বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ (অনুঃ ৩৫)
১০. চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৬)
১১. সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৭)
১২. সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৮)
১৩. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৯)
১৪. পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুঃ ৪০)
১৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা (অনুঃ ৪১)
১৬. সম্পত্তির অধিকার (অনুঃ ৪২)
১৭. গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ (অনুঃ ৪৩)
১৮. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের অধিকার (অনুঃ ৪৪)

নাগরিক রাজ্যের মুখ্য উপাদান কোন অধিকার কিভাবে রক্ষা করা যায়

জিরা ভূমিকা: নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে। নাগরিক যদি তার অধিকারসমূহ সুষ্ঠুভাবে ভোগ করতে না পারে বা বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে সে তার প্রতি অর্পিত রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলোও সঠিকভাবে পালন করবে না।

নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে উল্লেখ থাকে। এগুলো লঙ্ঘিত হলে নাগরিক আইনের আশ্রয় নিতে পারে। সেসব ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে নাগরিকগণ স্বীয় অধিকারকে রক্ষা করতে পারে সেগুলোকে অধিকারের রক্ষাকবচ বলে।

নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচসমূহ সুষ্ঠু সামাজিক জীবনের জন্য অধিকার অপরিহার্য। কিন্তু প্রত্যেক সমাজে নাগরিকগণ তার অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা ব্যক্তি কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য কতকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক শর্ত রয়েছে।এগুলো অধিকারের রক্ষাকবচ নামে পরিচিত।
নিম্নে নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচগুলো আলোচনা করা হলো

১. আইন: আইন নাগরিক অধিকারের প্রধান রক্ষাকবচ। আইন ছাড়া সভ্য সমাজ কল্পনা করা যায় না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ অধিকারকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। আইনের মধ্যে নিহিত শাস্তির ভয় মানুষকে অন্যায় কর্ম এবং অপরের অহেতুক ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

আইনের অনুশাসন প্রবর্তিত হলে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়। মন্টেকু বলেন, "আইনের দ্বারা আরোপিত শাস্তির প্রকৃতি ও পরিমাণের উপর অধিকারের সংরক্ষণ ও বিনাশ নির্ভরশীল।"

২. গণতান্ত্রিক শাসন: গণতন্ত্রে জনগণের হাতে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনগণ সর্বাধিক সুযোগ- সুবিধা এবং স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। গণতন্ত্রে জনগণই সর্বেসর্বা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই তাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং গণতন্ত্র নাগরিক অধিকারের অন্যতম রক্ষাকবচ।

৩. মৌলিক অধিকার: মৌলিক অধিকারসমূহ নাগরিকের অধিকার রক্ষার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। নাগরিক অধিকারসমূহ রক্ষা করার ক্ষেত্রে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ঘোষণা থাকা আবশ্যক। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্রের সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে।

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা প্রদান করা হয়ে থাকে। ফলে শাসকবর্গের উপর এর দ্বারা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। কেননা শাসকবর্গ সংবিধানকে উপেক্ষা করে জনগণের জন্য ঘোষিত অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এর ফলে সরকার এ সকল অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে বরং রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হয়।

৪. আইনের শাসন: আইনের শাসন নাগরিক অধিকারের অন্যতম রক্ষাকবচ। এ ব্যবস্থায় সকল নাগরিককে আইনের চোখে সমানভাবে দেখা হয়। যেকোনো প্রকার জুলুম, নির্যাতন এবং স্বেচ্ছাচারমূলক গ্রেফতার ও আটকের বিরুদ্ধে আইনের শাসন নাগরিক অধিকারসমূহ রক্ষা করে।

৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাগরিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের উপর নির্ভরশীল থাকলে অথবা আইন পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে বিচারকগণ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনায় সক্ষম হবেন না।

নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকার সমুন্নত রাখে।

৬. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও অধিকার সংরক্ষণের অন্যতম মাধ্যম। কেননা যে রাষ্ট্রে সংবাদপত্র নির্ভীকভাবে খবর পরিবেশনে ব্যর্থ হয় সে রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার খর্ব হতে বাধ্য।

নাগরিক অধিকার বিঘ্নিত হলে সংবাদপত্রগুলো সোচ্চার হয়ে উঠে। সংবাদপত্রের লেখনী ও প্রতিবাদ গণমনে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদেরকে অধিকার আদায়ে সচেষ্ট করে তোলে।

৭. জনগণের সজাগ দৃষ্টি: জনগণের সজাগ ও সচেতন দৃষ্টি অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। জনসাধারণ যদি নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং সচেতনতার সাথে সেই অধিকারগুলো রক্ষা ও উপভোগের ব্যবস্থা করে তাহলে কোনো শক্তিই অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। অধ্যাপক লাঙ্কি বলেন, "Eternal vigilance is the price of liberty," অর্থাৎ সার্বক্ষণিক সজাগ

দৃষ্টির মাঝেই স্বাধীনতার মূল্য নিহিত। ৮. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা: জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকারকে সংরক্ষিত করে। যেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় না সেখানে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশে অধিকার রক্ষার অন্যতম শর্ত হচ্ছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।

৯. শাসক ও শাসিতের সহযোগিতা: রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের অন্যতম রক্ষাকবচ হলো শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক সহযোগিতা। মূলত নাগরিকের অধিকার বাস্তবায়ন বা নিশ্চয়তার সকল দায়িত্ব শাসক বা সরকারের উপর অর্পণ করে বসে থাকলে তা পরিপূর্ণ হবে না। এর সঙ্গে শাসিতকেও সরকারের সহযোগিতা করতে হবে।

১০. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তবায়ন নাগরিকের অধিকার আদায়ের জন্য একান্ত আবশ্যক। কেননা এ নীতিতে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব এক হাতে কেন্দ্রীভূত না থেকে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিন্যস্ত থাকে। ফলে সকল স্তরে নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ ও নিশ্চয়তা বিধান করা সহজ হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার রক্ষার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। সুসভ্য সামাজিক জীবনযাপন এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য নাগরিকগণকে তার অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা রাষ্ট্রই প্রদান করে থাকে। কেননা নাগরিক যদি অধিকার ঠিকমতো ভোগ না করতে পারে তাহলে সে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যও পালন করবে না।

সুষ্ঠু সামাজিক জীবন বিকাশ এবং রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে নাগরিক অধিকারসমূহ অত্যাবশ্যক। তাই নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচগুলো শক্তিশালী করার জন্য জনগণকেই সচেষ্ট হতে হবে।

অধিকার কাকে বলে ও কত প্রকার

সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আত্মবিকাশের জন্য মানুষের প্রয়োজন কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা। সাধারণভাবে এসব সুযোগ-সুবিধাকে অধিকার বলা হয়। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত কতকগুলো সুযোগ-সুবিধার সমষ্টিই অধিকার।

মানবসমাজে বিদ্যমান অধিকারের ধারণাটি অত্যন্ত সুপ্রাচীনকালের। বলা যায়, রাষ্ট্রের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের অধিকারগুলো আইনি প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। তবে অধিকারের ধারণা কখনই স্থিতিশীল নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিভিন্নভাবে অধিকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন।

অধিকারের শ্রেণিবিভাগ/প্রকারভেদ/ধরন প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে অধিকারকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
  • নৈতিক অধিকার ও
  • আইনগত অধিকার।
আইনগত অধিকারকে আবার ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. সামাজিক অধিকার, 
২. রাজনৈতিক অধিকার, 
৩. অর্থনৈতিক অধিকার 
৪. সাংস্কৃতিক অধিকার, 
৫. ধর্মীয় অধিকার ও 
৬. ব্যক্তিক অধিকার। 

নৈতিক অধিকার কাকে বলে

নৈতিক অধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বুঝায় যা সমাজের নৈতিকতাবোধ বা ন্যায়বোধ থেকে উদ্ভূত। সমাজের নৈতিকতা বা ন্যায়বোধ থেকে নৈতিক অধিকারের উদ্ভব। যেমন-দরিদ্রের সাহায্য পাবার অধিকার, ভিক্ষুকের ভিক্ষা পাবার অধিকার ইত্যাদি।

এ অধিকার লঙ্ঘন করলে বিবেকের দংশন বা লোকনিন্দা সহ্য করতে হয় মাত্র, রাষ্ট্র এ বিষয়ে নীরব থাকে। এ অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত নয়। তাই নৈতিক অধিকার ভঙ্গ হলে নাগরিককে কোনোরূপ শাস্তি পেতে হয় না।

আইনগত অধিকার কাকে বলে

আইনগত অধিকার বলতে ব্যক্তির সে অধিকারকে বুঝায় যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং অনুমোদিত। আইনগত অধিকারের পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তথা আইনের সমর্থন। এ অধিকার ভঙ্গকারীকে রাষ্ট্রীয় বিধান অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়। নিম্নে আইনগত অধিকারের শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করা হলো:

সামাজিক অধিকার কাকে বলে

যেসব অধিকার নাগরিকের সভ্য জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য সেগুলোকে সামাজিক অধিকার বলে। নাগরিকের জীবনধারণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এ অধিকার অপরিহার্য। জীবনধারণের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মচর্চার অধিকার প্রভৃতি সামাজিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত।

আধুনিক ও উন্নত সামাজিক জীবনের জন্য অপরিহার্য বিধায় রাষ্ট্র এ অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয় ও সংরক্ষণ করে। ২. রাজনৈতিক অধিকার: রাজনৈতিক অধিকার বলতে সে অধিকারগুলোকে বুঝায় যার মাধ্যমে নাগরিকগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস বিধায় রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। কেবল রাষ্ট্রের নাগরিকগণই এ অধিকার ভোগ করতে পারে, কোনো বিদেশি বা অস্থায়ী বাসিন্দা নয়। ভোটদানের অধিকার, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, দল গঠনের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক অধিকার।

অর্থনৈতিক অধিকার কাকে বলে

যে অধিকার ব্যক্তিকে অভাব ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়ে অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান করে তাকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে। অর্থনৈতিক অধিকারসমূহ হচ্ছে কর্মের অধিকার, ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার ইত্যাদি।

অধ্যাপক লাঙ্কি বলেন, "...the opportunity to find reasonable significance in the earning of one's daily bread." অর্থাৎ..... অর্থনৈতিক অধিকার বলতে দৈনন্দিন অন্নসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ। খুঁজে পাওয়ার সুযোগ-সুবিধাকে বুঝায়।তিনি আরো বলেন যে, এসব সুযোগ-সুবিধা ছাড়া মানুষ সভ্যতার অভিশাপে পরিণত হয়, বস্তিতে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়

এবং কারাগারের অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বার্কার বলেন যে, অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া রাজনৈতিক অধিকারের কোনো গুরুত্ব নেই। অর্থনৈতিক দিক থেকে পরাধীন ব্যক্তি রাজনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন হতে পারে না। নিরন্ন মানুষের কাছে ভোটদানের অধিকার প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।

সাংস্কৃতিক অধিকার কাকে বলে

নিজ নিজ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ও পালনের অধিকারকে সাংস্কৃতিক অধিকার বলে। এ অধিকার বলে একজন ব্যক্তি ও একেকটি জাতি তার নিজস্ব চিন্তা ও চেতনার দ্বারা নিজেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে।

যেমন-শিক্ষার অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অধিকার। এ অধিকার সংরক্ষণের জন্য দেশের কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।

ধর্মীয় অধিকার কাকে বলে

ধর্মীয় অধিকার বলতে প্রত্যেক নাগরিকের ইচ্ছামতো ধর্মমত গ্রহণ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ও ধর্মীয় মতামত প্রকাশ সংক্রান্ত অধিকারকে বুঝায়। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার ধর্মীয় অধিকার।

এ অধিকার অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তির যেমন স্বীয় ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে, তেমনি অন্যের ধর্মীয় উপাসনা, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও ধর্ম প্রচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।

ব্যক্তিক অধিকার কাকে বলে

ব্যক্তিক অধিকার বলতে প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সুযোগ-সুবিধাকে বুঝায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, জীবনরক্ষার অধিকার, গৃহের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, খ্যাতিলাভের অধিকার ইত্যাদি হচ্ছে ব্যক্তিক বা ব্যক্তিগত অধিকার।

জাতিসংঘ স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই জীবনধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উল্লিখিত অধিকারসমূহ একজন নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। নাগরিকদের এসব অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে এবং নাগরিকদের তা ভোগ করতে সহায়তা করে।

এ অধিকার কেউ হরণ করলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করে। সংবিধান, আইন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন সংস্থা নাগরিক অধিকার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করে। বাংলাদেশ সংবিধানেও এসব অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

লেখকের মন্তব্য

প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আর্টিকেলটিতে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে জানা উচিত কারন এটা আমাদের প্রাপ্য অধিকার। সেইদিক বিবেচনা করেই যাচাইকৃত তথ্য দ্বারা এই আর্টিকেলটি লেখা হয়েছে।

আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে তার সম্পর্কে আপনি ধারণা পেয়েছেন।যদি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে এটি আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। যাতে করে তারাও এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।

এছাড়াও আরো অন্যান্য আর্টিকেল গুলো যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞানমূলক , চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী,বিভিন্ন আবিষ্কার ও আবিষ্কারক, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আরো অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।

কারণ এ ধরনের আর্টিকেলগুলো আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি।আর এই পোস্ট সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন মতামত কিংবা কোন পরামর্শ থাকে তাহলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন। যাতে করে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। আরো অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকে এখানে শেষ করছি ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।

পরিশেষে আর্টিকেলটি সম্পন্ন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url