স্বাধীনতা কাকে বলে,কত প্রকার ও কি কি
আমরা সবাই স্বাধীনভাবে চলতে পছন্দ করি? কিন্তু আমরা কি জানি স্বাধীনতা কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি
ভূমিকা
বর্তমানকালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীনতা সর্বজনস্বীকৃত। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। সুতরাং শুধু আইনে স্বাধীনতার কথা স্বীকার করলেই চলবে না, তাকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে। কোনো সংগঠিত সমাজেই মানুষ স্বাধীন হতে পারে। সমাজবিহীন কোনো অবস্থাতেই কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না।
মানুষের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ হলো স্বাধীনতা।স্বাধীনতার সংজ্ঞা: ইংরেজি 'Liberty' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে 'স্বাধীনতা'। ল্যাটিন শব্দ 'Liber' থেকে 'Liberty' শব্দটি এসেছে। 'Liber' শব্দের অর্থ স্বাধীন বা মুক্ত। সুতরাং শাব্দিক অর্থে স্বাধীনতা বলতে মানুষের যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতাকে বুঝায়।
সাধারণত অপরের কাজে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করে নিজের কাজ করা অথবা নিজের কাজে অন্যের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে কাজটি সুসম্পন্ন করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা।
স্বাধীনতা কাকে বলে
প্রামাণ্য সংজ্ঞা সমুহ
টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green)-এর মতে, “মানুষের জীবন ও মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যসম্পাদনের ক্ষমতাই হলো স্বাধীনতা।" অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেন, "স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সেই পরিবেশের সাগ্রহ সংরক্ষণ যেখানে মানুষ তার নিজ জীবনের চরম বস্বাধীনতা উপভোগে বাধার সৃষ্টি না হয়।"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলি (Seely) বলেন, "অতি-শাসনের বিপরীত ব্যবস্থাই হলো স্বাধীনতা।"
অধ্যাপক হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) বলেন, "স্বাধীনতা বলতে খুশিমতো কাজ করা বুঝায়, যদি উক্ত কাজ দ্বারা অন্যের অনুরূপ সার্থকতা লাভের সুযোগ পায়।”
ডব্লিউ. এ. হোয়াইট (W. A. White) বলেন, “স্বাধীনতা এমন একটি জিনিস যা তুমি অন্যকে না দিয়ে নিজে পেতে পার না।"
অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার (Ernest Barker) বলেন, "প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা সকলের স্বাধীনতার প্রয়োজনের দ্বারা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক।"
জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill)-এর মতে, "মানুষের মৌলিক শক্তির বলিষ্ঠ, অব্যাহত ও বিভিন্নমুখী প্রকাশই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অর্থ মানুষ কর্তৃক নিজস্ব উপায়ে কল্যাণ অনুধাবন করা।" তিনি আরো বলেন, "নিজের উপর, নিজের দেহ ও মনের উপর ব্যক্তিই সার্বভৌম।"
ফরাসি রাষ্ট্রদার্শনিক রুশো (Rousseau) বলেন, "আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই হলো স্বাধীনতা।"
জি. ডি. এইচ. কোল (G. D. H. Cole) বলেন, "ব্যক্তির স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাহ্যিক অন্তরায় সৃষ্টি না করে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন হলো স্বাধীনতা।"
সি. ডি. বার্নস (C. D. Burns)-এর মতে, "Liberty means to grow to one's natural heights to develop one's abilities." অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তির সামর্থ্য অনুযায়ী তার নিজের স্বাভাবিক অধিকারসমূহকে বিকশিত করা বুঝায়।
উপসংহারঃউপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, স্বাধীনতা অধিকারের সৃষ্টি। স্বাধীনতা সভ্য মানবসমাজের জন্য একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক আদর্শ।স্বাধীনতা হলো এমন একটি সামাজিক
অবস্থা বা পরিবেশ যেখানে প্রয়োজনীয় অধিকার ভোগ করা যায় এবং ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের মাধ্যমেই এরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কাকে বলে
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এটি মানুষের অমূল্য সম্পদ। কারো স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটি কেউ চায় না। সাধারণত স্বাধীনতা বলতে বুঝায় বাধা-বন্ধনহীনভাবে কাজ করার অধিকার। তবে স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই করা নয়, বরং স্বাধীনতার মানে হচ্ছে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার ভোগ করা।মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একটি অন্যতম অধিকার।ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে বুঝায় কোনোরূপ বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন না হয়ে একজন ব্যক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্যভাবে বলা যায়, নিজের পরিকল্পনা ও চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী চলাই হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে পোশাক-আশাক নির্বাচন করা, বিবাহ করা, পছন্দ অনুযায়ী খাদ্যগ্রহণ করা, মান বা সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনযাপন করা, সন্তানদের শিক্ষা প্রদান করা ইত্যাদি। সেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে।
এরূপ স্বাধীনতা ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বাহ্যিক কিছু আচরণের উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা। ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে রাষ্ট্র কোনোরূপ বাধা প্রদান করতে পারে না। আর ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো আইন পাস করলেও মানুষ তা মেনে নেয় না, বরং প্রতিবাদমুখর হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হলে জনগণ ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বিবেচনা করে এর তীব্র বিরোধিতা করে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় বিশ্বের কোনো দেশের জনগণই ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর সরকার বা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মেনে নিবে না।
রাষ্ট্র যেমন ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তেমনি কোনো ব্যক্তিও কারো ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিতান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। আর ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। এতে করে ব্যক্তি সমাজে স্বীয় স্থান সুসংহত করতে পারে।
ফলে ব্যক্তি নিজেও যেমন উপকৃত হয় তেমনি তার দ্বারা গোটা দেশ ও জাতি উপকৃত হয়। অর্থাৎ দেশ ও জাতির কল্যাণে সে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সে সমাজে-রাষ্ট্রে নিজের স্থান সুসংহত করতে পারে না।
এতে করে ব্যক্তির নিজের ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তেমনি তার দ্বারা অন্য কেউ উপকৃত হয় না। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর কোনো হস্তক্ষেপ বা বাধা আসলে ব্যক্তি তা প্রতিহত করে। আর এতে করে বিশৃঙ্খলারও সৃষ্টি হয় এবং সার্বিকভাবে সকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং প্রত্যেকের কাছে এটি মূল্যবান। ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর রাষ্ট্র, ব্যক্তি নির্বিশেষে কারো হস্তক্ষেপ ব্যক্তি মেনে নিতে নারাজ। আর এর ফলও শুভ হয় না। তাই সকলের উচিত ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা এবং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ।
সামাজিক স্বাধীনতাকাকে বলে
যেসব সুযোগ-সুবিধা সুসভ্য জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য বা সর্বাধিক ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ করে সেসব সুযোগ-সুবিধাকে সামাজিক স্বাধীনতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক স্বাধীনতা হলো সে স্বাধীনতা যে স্বাধীনতা সমাজের ন্যায়বোধ দ্বারা স্বীকৃত এবং সামাজিক বিধি-বিধান দ্বারা সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।জীবন রক্ষা, কথা বলা, সংঘ গঠন, ধর্ম পালন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষার্জন ইত্যাদি সামাজিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার একটি উল্লেখযোগ্য ধরন হলো সামাজিক স্বাধীনতা। সামাজিক স্বাধীনতা বাদ দিয়ে সামাজিক জীবনের কথা চিন্তা করা যায় না। বৃহত্তর সামাজিক জীবনে মানুষ সামাজিক স্বাধীনতা ভোগ করে।
আর সামাজিক স্বাধীনতা অবশ্যই আইনসম্মত বিধানে স্বীকৃত হতে হবে। আইনের স্বীকৃতি না পেলে সে সামাজিক স্বাধীনতা বৈধতা পায় না। সমাজজীবনকে সুন্দর করার নিমিত্ত সমাজ কর্তৃক স্বীকৃতির মাধ্যমেই সামাজিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক স্বাধীনতায় সামাজিক ঐতিহ্য, রীতিনীতি, বিধি ও নৈতিকতা ইত্যাদি স্বীকৃত।
রাষ্ট্র নাগরিকের সামাজিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ করে থাকে। কারণ রাষ্ট্র যদি সামাজিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ না করে তাহলে সমাজের মানুষ এ স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবে। উল্লেখ্য, আইনসংগত স্বাধীনতার ন্যায় সামাজিক স্বাধীনতা সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট নয়। সামাজিক স্বাধীনতার ধারণা পরিবর্তনশীল।
আবার দেশভেদে বা সমাজভেদে সামাজিক স্বাধীনতায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক স্বাধীনতার ধারণাও পরিবর্তনশীল। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিস্তার ঘটায় অনেক সামাজিক স্বাধীনতার ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক সময় দাপ্রথা প্রচলিত ছিল এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দাস রাখার অধিকার ছিল।
কিন্তু বর্তমানে এ স্বাধীনতা খর্বিত হয়েছে। অর্থাৎ এখন আর কোনো বিত্তবান ব্যক্তি কাউকে দাস বানাতে পারবে না বা দাস হিসেবে রাখতে পারবে না। অনেক সময় রাষ্ট্র সামাজিক স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। যেমন- বিবাহ অনুষ্ঠান পালন ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। অনেক সময় সামাজিক স্বাধীনতা অমানবিকতার জন্ম দেয়। যেমন- ভারতীয় উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথা সামাজিক স্বাধীনতা হলেও তা ছিল অমানবিক। রাষ্ট্রকে এ ধরনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব। তাই তার সামাজিক স্বাধীনতা থাকা অত্যাবশ্যক। কেননা সামাজিক স্বাধীনতা ব্যতিরেকে মানুষের সামাজিক বিকাশ ঘটে না।
আর মানুষের সামাজিক বিকাশ না ঘটলে বা সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর এর প্রভাব পড়ে সমাজের মানুষের উপর। আর এ থেকে সামাজিক স্বাধীনতার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।
আইনগত স্বাধীনতা কাকে বলে
আইনগত স্বাধীনতা বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের দ্বারা স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, আইনগত স্বাধীনতা এমন একটি স্বাধীনতা, যা রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অনুমোদিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনগত স্বাধীনতাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলে। এ স্বাধীনতা অর্জিত, সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত।কোনো স্বাধীনতাই নিয়ন্ত্রণবিহীন বা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। যে স্বাধীনতার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা যে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণবিহীন তা কোনো স্বাধীনতাই নয়। রাষ্ট্র সমাজের তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থের মানসে প্রত্যেকের স্বাধীনতার উপর কিছু না কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। দেশের সংবিধানে ও রাষ্ট্রীয় আইনে এসব স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে।
মানুষ সমাজের সভ্য হিসেবেই স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের মধ্যেই স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বাইরে স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের কথা কল্পনাও করা যায় না। যে রাষ্ট্রে আইনগত স্বাধীনতা নেই সে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে পারে না।
কেননা সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পায়। কেউ হয়তো মনে করতে পারেন আইন স্বাধীনতার পরিপন্থী বা আইন মানুষের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু এটি সঠিক নয়। আইন স্বাধীনতার সম্পূরক নয়; বরং পরিপূরক। আইন মানুষের স্বাধীনতার কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না বরং প্রকৃত স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে।
আইনের মধ্যে থেকেই প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করবে তা অবশ্যই আইনসম্মত হতে হবে। যে স্বাধীনতাকে আইন সমর্থন করে না বা যা আইনগত স্বাধীনতা নয় তা কোনো স্বাধীনতাই নয় এবং সে রকম স্বাধীনতার ভোগ করতে চাওয়াটা এক ধরনের বোকামি ও অপরাধ। আর এর মধ্যে মানুষের কোনো কল্যাণ নেই।
আইনের মধ্যে থেকে বা আইনসম্মত স্বাধীনতার মধ্যেই যে মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা সব সময় রক্ষিত হবে তাও হলফ করে বলা যায় না। আইনের মধ্যে থেকে তথা আইনের গণ্ডির মধ্যেও অনেক সময় মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হয়। স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্ব যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তখন আইন দিয়েই মানুষের অনেক স্বাধীনতা বা অধিকার খর্ব করে।
আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও অনেক সময় ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখ্যালঘুর প্রকৃত স্বাধীনতাকে খর্ব করে। নাগরিকদের স্বাধীনতাসমূহের মধ্যে আইনগত স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আইনগত স্বাধীনতা হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা। এর মধ্যে দিয়েই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পায়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে আইনগত স্বীকৃতির মধ্য দিয়েও মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পায় না।
ব্যক্তিস্বার্থে বা অশুভ স্বার্থে কোনো সরকার যখন আইন দিয়েই মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে তখন আইনগত স্বাধীনতাও মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার অন্তরায় হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক স্বাধীনতাকাকে বলে
রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংজ্ঞাঃ রাষ্ট্রের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করার স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলা হয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতার বলে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারকে বুঝায়।ভোটদানের অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, নিরপেক্ষ রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত একজন নাগরিক পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।
ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের যথোচিত বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে। মোটকথা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হলো এমন সব সুযোগ-সুবিধা যেখানে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক যেকোনো কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: অধ্যাপক এইচ. জে. লাস্কি (J. H. Laski)-এর মতে, "Political liberty means the power to be active in the affairs of the state." অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে সক্রিয় থাকার অধিকারকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেন, "রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে অংশগ্রহণ করার অধিকারকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে।"
অধ্যাপক বার্কার (Barker)-এর মতে, "সমাজের সদস্য হিসেবে এবং আইনসঙ্গত সংগঠনের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত অধিকারকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে।"
অধ্যাপক স্টিফেন লিকক (Stephen Leacock) বলেন, "Political liberty as constitutional liberty." অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতা হলো সাংবিধানিক স্বাধীনতা।
ড্যানিয়েল উইট (Daniel Wit) বলেন, "The question of liberty is political and ethical:" অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রশ্নই হলো রাজনৈতিক ও নৈতিক। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist) রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে 'গণতন্ত্রের সমর্থক' বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা দান করে।
শিক্ষার প্রসার এবং নিরপেক্ষ পত্র-পত্রিকাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রে নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে নাগরিক জীবন বিষময় হয়ে উঠে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কাকে বলে
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংজ্ঞা: অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ হলো যোগ্যতা ও সামর্থ্যানুযায়ী উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের অবাধ ও অনুপম ব্যবস্থা যা দ্বারা দৈনন্দিন অভাব ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলে।কাজ করা, ন্যায্য মজুরি পাওয়া, বেকার না থাকা ইত্যাদি বিষয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূলকথা হলো নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য উপযুক্ত মজুরি লাভের অধিকার নিশ্চিত করা।" অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানে অর্থনীতি সংক্রান্ত সকল বিষয়ের স্বাধীনতা।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্থহীন। সমাজের সেই পরিবেশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে যেখানে জনসাধারণ সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে ইচ্ছামতো পেশা গ্রহণ, ভালো মজুরি অর্জন এবং সমাজের অন্যান্য শ্রেণির শোষণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্র তার নাগরিককে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদানের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অর্থনৈতিকভাবে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রোজগার এবং সেক্ষেত্রে শ্রম নির্বাচনে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির অধিকারই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ বুঝা যায় না।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যেন প্রতিটি নাগরিক যোগ্যতানুসারে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করতে পারে।
লেখকের মন্তব্য
প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আর্টিকেলটিতে স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি এই সম্পর্কে জানা উচিত। সেইদিক বিবেচনা করেই যাচাইকৃত তথ্য দ্বারা এই আর্টিকেলটি লেখা হয়েছে।আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে তার সম্পর্কে আপনি ধারণা পেয়েছেন।যদি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে এটি আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। যাতে করে তারাও এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
এছাড়াও আরো অন্যান্য আর্টিকেল গুলো যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞানমূলক , চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী,বিভিন্ন আবিষ্কার ও আবিষ্কারক, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আরো অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।
কারণ এ ধরনের আর্টিকেলগুলো আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি।আর এই পোস্ট সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন মতামত কিংবা কোন পরামর্শ থাকে তাহলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন। যাতে করে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। আরো অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকে এখানে শেষ করছি ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
পরিশেষে আর্টিকেলটি সম্পন্ন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।
বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url