বিপ্লব বলতে কি বুঝায়
বিপ্লব শব্দটার সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। তবে আমরা কি জানি যে এই শব্দটার অর্থ আসলে কি? চলুন জেনে নেয়া যাক বিপ্লব বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত।
কিন্তু এরিস্টটল রাষ্ট্রের সংবিধান বা সরকার পরিবর্তনহেতু সৃষ্ট অস্থিতিশীল অবস্থাকে বিপ্লবরূপে অভিহিত করেছেন বিপ্লবের সংজ্ঞা: 'বিপ্লব করাই বিপ্লব। বিপ্লব মূলত সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সার্বিক পরিবর্তন সাধন করে।
"বিপ্লব হচ্ছে একটি শ্রেণির হাত থেকে অন্য শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেই ক্ষমতা হস্তান্তর যেকোনো উপায়েই হোক না কেন।" তিনি আরো বলেন, "বিপ্লব হলো পুরনো সমাজব্যবস্থা ভেঙে এক নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।"
"বিপ্লব বলতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শাসকগোষ্ঠীর উৎখাত এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনকে বুঝায়।" বিপ্লবের প্রকৃতি: এরিস্টটল বিপ্লব সম্পর্কে বলেন যে, বিপ্লব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে বিপ্লব হতে পারে অথবা বিপ্লবীরা সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার সমগ্র সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব না ঘটে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটতে পারে। এছাড়া বিপ্লব সম্পূর্ণ, আংশিক, সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণও হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব তার একটি কালজয়ী ধারণা বা সৃষ্টি। আজ থেকে ২,৫০০ বছর পূর্বে বিপ্লব সম্পর্কে তিনি যে ধারণা দিয়েছেন তা আজো অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও দার্শনিকের নিকট শিক্ষার উপকরণ হিসেবে বিবেচিত।
১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ : রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার বাইরে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা থেকে তাদের যোগ্যতা কোনো অংশে কম নয়। এ থেকে তাদের মনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ভাবাবেগের উদ্রেক হয়। তারা মনে করে, শাসন ক্ষমতা লাভের ন্যায্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত।
পক্ষান্তরে, ধনী ও বিত্তশালীরা মনে করে, জ্ঞানে-গুণে তারা সমাজের অন্যান্যদের চেয়ে উঁচুস্তরে অবস্থান করে। কিন্তু অধিকার ভোগের বেলায় অন্যান্যদের সমপরিমাণ ভোগ করে। উভয় শ্রেণিই মনে করে, তাদের দ্বারা পরিচালিত বিপ্লব ন্যায়বিচারের আদর্শে পরিচালিত।
এজন্য বঞ্চিত শ্রেণি বিপ্লব করায়ত্ত করে শাসকের সমপর্যায়ে উন্নীত হতে চায় এবং শাসকচক্র শ্রেণিগত অসাম্য রক্ষা করে তা নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চান। ৩. শাসক শ্রেণির দুর্নীতি ও অত্যধিক ধনলিপ্সা: শাসক শ্রেণির অতিরিক্ত ঔদ্ধত্য ও ধনলিপ্সার কারণে গণমনে ঘোর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
৫. রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ বা অংশের অসামঞ্জস্য প্রসার: রাষ্ট্রের কোনো অংশের অস্বাভাবিক প্রসার বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে। এরিস্টটলের মতে, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে যেমন তার সঠিক কার্যকারিতা বিনষ্ট হয় তেমনি রাষ্ট্রের কোনো একটি শ্রেণি যদি সহসা অত্যধিক দরিদ্র বা ধনী হয়ে উঠে তবে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৬. মুনাফা বা সম্মান লাভের বাসনা: অনেক সময় দেখা যায় যে, ন্যায়বিচারের আদর্শের মধ্যে বৈষয়িক লাভের আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা লুক্কায়িত থাকে। বিপ্লবের সাফল্যের সাথে সম্মান ও মুনাফা লাভের যে সম্ভাবনা থাকে তা থেকেই অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগানো হয়।
৭. সাম্প্রদায়িক, বংশগত ও ক্ষমতার সংঘাত: সাম্প্রদায়িক, বংশগত ও ক্ষমতার সংঘাতের কারণে অনেক সময় পারিবারিক কলহ ও বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। এছাড়া ক্ষমতালোভী প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণি বা রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক কলহও বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
৮. কোনো শ্রেণির আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো শ্রেণির সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবিকে অস্বীকার করা হয়, তাহলেও বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৯. কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কোনো ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
১০. খেতাব প্রদানের বৈষম্য সরকার যদি সমমর্যাদাসম্পন্ন কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে খেতাব প্রদান করে তবে একই মর্যাদাভুক্ত ব্যক্তিরা অসন্তুষ্ট হয়ে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে।
১১. সরকারের দুর্নীতি: ক্ষমতাসীন সরকার যখন স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং যথেচ্ছভাবে সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করে তখন সেই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ বিপ্লব ঘটাতে তৎপর হয়।
১২. সরকারের প্রতি অনাস্থা বা ঘৃণা: সরকারের প্রতি অনাস্থা বা ঘৃণা থেকেও বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। কোনো কারণে যদি সরকারের প্রতি জনসমষ্টির কোনো অংশের মধ্যে অনীহা বা ঘৃণার ভাব জাগ্রত হয় তখন বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে।
১৩. বিতর্কিত সিদ্ধান্ত: আদালতের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেও বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। যেমন- নগররাষ্ট্র হেরাক্লিয়া ও থিবিস-এর বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের পিছনে কাজ করেছে আদালতের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত।
১৪. মানসিক অসন্তুষ্টি: অনেক সময় সমাজের কিছু লোক মনে করে যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের যোগ্যতা কোনোঅংশেই কম নয়। তাহলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না কেন- এরূপ মানসিক অসন্তুষ্টি থেকে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
তাতে সাধারণ মানুষের মনের ক্ষোভ দূরীভূত হবে। এজন্য শাসক ও বঞ্চিতদের মধ্যে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। এর মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৪. আইনের প্রতি আনুগত্য আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিহত করা সম্ভব। জনগণ যখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তখন বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে। আইনের অনুপস্থিতিতে বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
৫. সদা সতর্ক শাসক: বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য শাসককে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণ জনগণের উপর যাতে অবিচার করা না হয় এবং গুণী ব্যক্তিরা যাতে তাদের প্রতিভার উপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করতে পারে তার প্রতি শাসক শ্রেণির সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
৬. জনগণের আস্থা অর্জন: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গকে জনগণের নিকট থেকে আস্থা অর্জন হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উন্মুক্ত রাখা। এতে করে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হবে এবং জনগণও সরকারের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠবে। ফলে বিপ্লব অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যাবে।
আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে তার সম্পর্কে আপনি ধারণা পেয়েছেন।যদি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে এটি আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। যাতে করে তারাও এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
এছাড়াও আরো অন্যান্য আর্টিকেল গুলো যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞানমূলক , চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী,বিভিন্ন আবিষ্কার ও আবিষ্কারক, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আরো অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।
কারণ এ ধরনের আর্টিকেলগুলো আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি।আর এই পোস্ট সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন মতামত কিংবা কোন পরামর্শ থাকে তাহলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন। যাতে করে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। আরো অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকে এখানে শেষ করছি ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
পরিশেষে আর্টিকেলটি সম্পন্ন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।
ভূমিকা
'বিপ্লব' শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Revolution. এর অর্থ হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। আধুনিককালে বিপ্লব বলতে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন কিংবা বিদেশি আগ্রাসন থেকে মাতৃভূমিকে উদ্ধার, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার আন্দোলনকে বুঝায়।কিন্তু এরিস্টটল রাষ্ট্রের সংবিধান বা সরকার পরিবর্তনহেতু সৃষ্ট অস্থিতিশীল অবস্থাকে বিপ্লবরূপে অভিহিত করেছেন বিপ্লবের সংজ্ঞা: 'বিপ্লব করাই বিপ্লব। বিপ্লব মূলত সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সার্বিক পরিবর্তন সাধন করে।
বিপ্লব বলতে কি বুঝায়
আধুনিক অর্থে বিপ্লব ' কথাটির অর্থ হলো পরিবর্তন। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে সমাজে নতুনত্বের সূচনা বলতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানসমূহের ক্রমবর্ধিষ্ণু ফলাফলকে বুঝায়। প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিপ্লব সম্পর্কে ভি. আই, লেনিন বলেন,"বিপ্লব হচ্ছে একটি শ্রেণির হাত থেকে অন্য শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেই ক্ষমতা হস্তান্তর যেকোনো উপায়েই হোক না কেন।" তিনি আরো বলেন, "বিপ্লব হলো পুরনো সমাজব্যবস্থা ভেঙে এক নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।"
কার্ল মার্কস তার 'The Critique of Political Economy' গ্রন্থে বলেন, "সমাজ বিকাশের কোনো এক পর্যায়ে উৎপাদনী শক্তিগুলো উৎপাদন সম্পর্কের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়- যে সম্পর্কের মাঝে তারা এতদিন বিকশিত হচ্ছিল; এটাই এক সময় সেকেলে হয়ে পড়ে আর তখনই তা রূপ নেয় সমাজ বিপ্লবে।" তিনি আরো বলেন,
"বিপ্লব বলতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শাসকগোষ্ঠীর উৎখাত এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনকে বুঝায়।" বিপ্লবের প্রকৃতি: এরিস্টটল বিপ্লব সম্পর্কে বলেন যে, বিপ্লব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে বিপ্লব হতে পারে অথবা বিপ্লবীরা সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার সমগ্র সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব না ঘটে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটতে পারে। এছাড়া বিপ্লব সম্পূর্ণ, আংশিক, সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণও হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব তার কালোত্তীর্ণ একটি ধারণা। আজ থেকে প্রায় ২,৫০০ বছর পূর্বে বিপ্লব সম্পর্কে তিনি যে ধারণা দেন তা আজো অনেকের কাছে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে বিবেচিত। তার এ চিন্তাধারা তাকে বাসতববাদী দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছে।
বিপ্লব সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ আলোচনা কর
'সাধারণভাবে বিপ্লব বলতে রক্তাক্ত বা সশস্ত্র আন্দোলনকে বুঝালেও মহান দার্শনিক এরিস্টটল বিপ্লব বলতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনকে বুঝিয়েছেন। আধুনিককালে বিপ্লব বা বিদ্রোহ বলতে শোষক, শাসক বা স্বৈরাচারীর কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্য গণআন্দোলনকে বুঝায়।বিদেশি শাসকের আগ্রাসন থেকে মাতৃভূমিকে উদ্ধার, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য বিপ্লব হতে পারে। কিন্তু এরিস্টটল রাষ্ট্রের সংবিধান বা সরকার পরিবর্তন হেতু সৃষ্ট অস্থিতিশীল অবস্থাকে বিপ্লবরূপে অভিহিত করেন।
এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব কি
এরিস্টটলের মতে, মানুষ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন, ক্ষমতা লাভ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বিপ্লব করে থাকে। তিনি বিপ্লব বলতে সেই ঘটনাকে বুঝিয়েছেন, যা সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
এরিস্টটল তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ 'The Politics'-এর পঞ্চম অধ্যায়ে বিপ্লব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেন।তিনি ১৫৮টি রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালোচনা করে বিপ্লবের কারণ ও তা প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা করেছেন।
এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব কি
এরিস্টটলের মতে, মানুষ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন, ক্ষমতা লাভ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বিপ্লব করে থাকে। তিনি বিপ্লব বলতে সেই ঘটনাকে বুঝিয়েছেন, যা সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
এরিস্টটল তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ 'The Politics'-এর পঞ্চম অধ্যায়ে বিপ্লব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেন।তিনি ১৫৮টি রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালোচনা করে বিপ্লবের কারণ ও তা প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা করেছেন।
বিপ্লবের প্রকৃতি
এরিস্টটল বিপ্লব সম্পর্কে বলেন যে, বিপ্লব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে বিপ্লব হতে পারে অথবা বিপ্লবীরা সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার সমগ্র সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব না ঘটে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটতে পারে।
এছাড়া বিপ্লব সম্পূর্ণ, আংশিক, সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণ হতে পারে। এছাড়া বিপ্লবের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে এরিস্টটল বলেন, বিপ্লব দুটি উৎস থেকে সংঘটিত হতে পারে। প্রথমত, বিপ্লব সৃষ্টি হয় সমাজের বিপ্লবীদের মেজাজের উপর ভিত্তি করে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থের বশবর্তী হলে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব তার একটি কালজয়ী ধারণা বা সৃষ্টি। আজ থেকে ২,৫০০ বছর পূর্বে বিপ্লব সম্পর্কে তিনি যে ধারণা দিয়েছেন তা আজো অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও দার্শনিকের নিকট শিক্ষার উপকরণ হিসেবে বিবেচিত।
এ তত্ত্বে এরিস্টটল বিপ্লবের যথার্থ কারণ যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি এর প্রতিকার সম্পর্কেও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তার এ চিন্তাধারা তাকে বাস্ত্যবাদী দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছে। এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব তাই সর্বকালে সর্বদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণসমূহ
অবস্থাকে বিপ্লবরূপে অভিহিত করেন। এরিস্টটলের মতে বিপ্লব/বিদ্রোহের কারণসমূহ এরিস্টটল বিপ্লবের কারণসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ক. সাধারণ কারণ খ. বিশেষ কারন
সাধারণ কারণ
এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব অনুসারে বিপ্লবের সাধারণ কারণসমূহ নিম্নরূপ:১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ : রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার বাইরে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা থেকে তাদের যোগ্যতা কোনো অংশে কম নয়। এ থেকে তাদের মনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ভাবাবেগের উদ্রেক হয়। তারা মনে করে, শাসন ক্ষমতা লাভের ন্যায্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত।
পক্ষান্তরে, ধনী ও বিত্তশালীরা মনে করে, জ্ঞানে-গুণে তারা সমাজের অন্যান্যদের চেয়ে উঁচুস্তরে অবস্থান করে। কিন্তু অধিকার ভোগের বেলায় অন্যান্যদের সমপরিমাণ ভোগ করে। উভয় শ্রেণিই মনে করে, তাদের দ্বারা পরিচালিত বিপ্লব ন্যায়বিচারের আদর্শে পরিচালিত।
২. অসাম্য ও ন্যায় সম্বন্দ্বে বিভিন্ন ধারণা: বিপ্লবের কারণ হচ্ছে শ্রেণিগত ন্যায়বোধ বা মানবের সহজাত সাম্য ও অসাম্য স্পৃহা। শাসন ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার স্পৃহা মানুষের সহজাত ধর্ম। এ থেকে যারা বঞ্চিত তাদের মনে বিদ্রোহ জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক।
এজন্য বঞ্চিত শ্রেণি বিপ্লব করায়ত্ত করে শাসকের সমপর্যায়ে উন্নীত হতে চায় এবং শাসকচক্র শ্রেণিগত অসাম্য রক্ষা করে তা নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চান। ৩. শাসক শ্রেণির দুর্নীতি ও অত্যধিক ধনলিপ্সা: শাসক শ্রেণির অতিরিক্ত ঔদ্ধত্য ও ধনলিপ্সার কারণে গণমনে ঘোর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া শাসকগণ যখন স্বার্থান্বেষী হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা জনস্বার্থকে পদদলিত করে একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হন বা চক্রান্ত করে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র গঠনের চেষ্টা করেন তখনই ভীত নাগরিকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
৪. ভয়ভীতি ও অবজ্ঞা প্রদর্শন: দুর্নীতিমূলক কাজের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তির ভয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অযথা বিদ্রোহের পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেদের দোষ ঢাকতে সচেষ্ট হয়। ভয়ভীতির মতো অবজ্ঞাও বিপ্লবের কারণ।
৫. রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ বা অংশের অসামঞ্জস্য প্রসার: রাষ্ট্রের কোনো অংশের অস্বাভাবিক প্রসার বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে। এরিস্টটলের মতে, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে যেমন তার সঠিক কার্যকারিতা বিনষ্ট হয় তেমনি রাষ্ট্রের কোনো একটি শ্রেণি যদি সহসা অত্যধিক দরিদ্র বা ধনী হয়ে উঠে তবে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৬. মুনাফা বা সম্মান লাভের বাসনা: অনেক সময় দেখা যায় যে, ন্যায়বিচারের আদর্শের মধ্যে বৈষয়িক লাভের আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা লুক্কায়িত থাকে। বিপ্লবের সাফল্যের সাথে সম্মান ও মুনাফা লাভের যে সম্ভাবনা থাকে তা থেকেই অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগানো হয়।
৭. সাম্প্রদায়িক, বংশগত ও ক্ষমতার সংঘাত: সাম্প্রদায়িক, বংশগত ও ক্ষমতার সংঘাতের কারণে অনেক সময় পারিবারিক কলহ ও বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। এছাড়া ক্ষমতালোভী প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণি বা রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক কলহও বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
৮. কোনো শ্রেণির আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো শ্রেণির সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবিকে অস্বীকার করা হয়, তাহলেও বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৯. কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কোনো ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
১০. খেতাব প্রদানের বৈষম্য সরকার যদি সমমর্যাদাসম্পন্ন কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে খেতাব প্রদান করে তবে একই মর্যাদাভুক্ত ব্যক্তিরা অসন্তুষ্ট হয়ে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে।
১১. সরকারের দুর্নীতি: ক্ষমতাসীন সরকার যখন স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং যথেচ্ছভাবে সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করে তখন সেই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ বিপ্লব ঘটাতে তৎপর হয়।
১২. সরকারের প্রতি অনাস্থা বা ঘৃণা: সরকারের প্রতি অনাস্থা বা ঘৃণা থেকেও বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। কোনো কারণে যদি সরকারের প্রতি জনসমষ্টির কোনো অংশের মধ্যে অনীহা বা ঘৃণার ভাব জাগ্রত হয় তখন বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে।
১৩. বিতর্কিত সিদ্ধান্ত: আদালতের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেও বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। যেমন- নগররাষ্ট্র হেরাক্লিয়া ও থিবিস-এর বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের পিছনে কাজ করেছে আদালতের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত।
১৪. মানসিক অসন্তুষ্টি: অনেক সময় সমাজের কিছু লোক মনে করে যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের যোগ্যতা কোনোঅংশেই কম নয়। তাহলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না কেন- এরূপ মানসিক অসন্তুষ্টি থেকে বিপ্লব সংঘটিত হয়।
বিশেষ কারণ
কোনো কারণে সংবিধানে বিপ্লব বা পরিবর্তন সংঘটিত হলে সেগুলো বিপ্লবের বিশেষ কারণ হিসেবে এরিস্টটলের আলোচিত হয়েছে। বিপ্লবের বিশেষ কারণগুলো নিম্নরূপ:১. স্বেচ্ছাচারিতা: গণতন্ত্রে অত্যধিক জনপ্রিয় নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য সৃষ্টি হয়।ফলে এক্ষেত্রে পেশাদারি রাজনীতিবিদগণ ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে ধনীদের উপর হামলা করতে পারে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করে গণতন্ত্র উৎখাত করতে পারে।গণতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও ধনীরা বিপ্লব করতে পারে।
২. ধনতান্ত্রিক শাসন: ধনিকতন্ত্রে বিপ্লব সংঘটিত হয় জনতার প্রতি অন্যায় ও অত্যাচারমূলক আচরণ করার ফলে। ধনীদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে ধনিকতন্ত্রীরা কুচক্রীতে পরিণত হয়ে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
৩. স্বৈরাচারী শাসন: স্বৈরাচারীদের উগ্র ও অত্যাচারী আচরণের ফলে শাসিতের মনে যে ঘৃণা ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয় তা বিপ্লবের আকারে বিস্ফোরণের সূচনা করে। ভিন্ন চরিত্রের কোনো রাষ্ট্র যদি স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবেশী হয় তবে বিপ্লব আরো ত্বরান্বিত হয়।
৪. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: বিপ্লবের একটি অন্যতম বিশেষ কারণ হলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থ ও ক্ষমতার দ্বন্দু ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হয়। এরিস্টটল মনে করেন, ধনিকতন্ত্রে বিত্তশালীরা নিজেদের মধ্যে অর্থ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আর এ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বিপ্লব ঘনীভূত হয়।
৫. অবৈধ নির্বাচন: গণতন্ত্রে অবৈধ নির্বাচনকে এরিস্টটল বিপ্লবের বিশেষ কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অনিয়ম হলে বিপ্লব সংঘটিত হয়। কারণ এরূপ রাষ্ট্রের জনগণ সচেতন বলে তারা নির্বাচনে অনিয়ম মেনে নেয় না।
৬. সামরিক অভ্যুত্থান: বিপ্লবের আরেকটি বিশেষ কারণ হলো সামরিক অভ্যুত্থান। এরিস্টটলের মতে, সামরিক অভ্যুত্থানসহ সকল অশুভ শক্তির ফলে জনগণ আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় জনগণ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপ্লব ঘটায়।
৭. অভিজাততন্ত্রে বিপ্লব: অভিজাততন্ত্রে বিপ্লব ঘটে ক্ষমতাসীনদের চক্র সংকুচিত হওয়ার ফলে। সংবিধানে ভারসাম্য সংরক্ষণের সুব্যবস্থা না থাকায় অভিজাতবর্গের অধিকতর সুযোগ সন্ধান করার ফলে বিপ্লব সংঘটিত হয়। ন্যায়বোধ থেকে বঞ্চিত হলে বা যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অসম্মানের ফলে বিপ্লব হতে পারে।
৮. রাজতন্ত্রে বিপ্লব: রাজতন্ত্রে বিপ্লব সংঘটিত হয় রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও কলহের মাধ্যমে। রাজা যখন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন তখন জনতা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে ও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহান দার্শনিক এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব তার কালজয়ী একটি সৃষ্টি। এ তত্ত্বে তিনি সমসাময়িক অনেকগুলো সমাজ সম্পর্কে গবেষণা করে বিপ্লবতত্ত্ব প্রকাশ করেন। এ তত্ত্বে তিনি বিপ্লবের অনেকগুলো কারণ তুলে ধরেন।
আজ থেকে ২,৫০০ বছর পূর্বে এরিস্টটল বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে ও তা প্রতিরাধে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা কালের গতিতে মোটেও ম্লান হয় নি। তার এ চিন্তাধারা তাকে বাস্তববাদী দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছেন।
এরিস্টটলের মতে বিপ্লব প্রতিরোধের উপায়
১. শাসক ও শাসিতের সুসম্পর্ক স্থাপন: এরিস্টটল শাসক ও শাসিতের মধ্যকার সুসম্পর্ককে বিপ্লব নিবারণের একটি বিশেষ পন্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশেষ করে শাসকগণ শাসিত-বঞ্চিতদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে।
তাতে সাধারণ মানুষের মনের ক্ষোভ দূরীভূত হবে। এজন্য শাসক ও বঞ্চিতদের মধ্যে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। এর মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
২. মধ্যমন্ত্র প্রতিষ্ঠা: এরিস্টটল নির্দেশিত সর্বাপেক্ষা বাস্তবভিত্তিক সরকার 'মধ্যমতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপ্লব রোধ করা সম্ভব। কেননা মধ্যমতন্ত্র সরকার ব্যবস্থায় এক ধরনের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ভারসাম্যাবস্থা রক্ষা করা সম্ভব।
৩. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অত্যধিক কেন্দ্রীকরণ জনগণকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করে। তাই বিপ্লব প্রতিরোধ করতে হলে এ অবস্থার প্রতিকার করতে হবে। এজন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
৪. আইনের প্রতি আনুগত্য আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিহত করা সম্ভব। জনগণ যখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তখন বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে। আইনের অনুপস্থিতিতে বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
৫. সদা সতর্ক শাসক: বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য শাসককে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণ জনগণের উপর যাতে অবিচার করা না হয় এবং গুণী ব্যক্তিরা যাতে তাদের প্রতিভার উপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করতে পারে তার প্রতি শাসক শ্রেণির সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
৬. জনগণের আস্থা অর্জন: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গকে জনগণের নিকট থেকে আস্থা অর্জন হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উন্মুক্ত রাখা। এতে করে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হবে এবং জনগণও সরকারের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠবে। ফলে বিপ্লব অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যাবে।
৭. সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা: বিপ্লব প্রতিরোধের লক্ষ্যে সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা পুনগঠন করা আবশ্যক, যাতে করে বাল্যকাল থেকেই নাগরিকগণ রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে।
৮. সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য: বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য বজায় রাখতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য দেখা দিলে বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। বেশির ভাগ বিপ্লবের মূলেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
৯. সম্পদ বণ্টনে সমানাধিকার: রাষ্ট্রীয় সম্মান, রাষ্ট্রীয় পদ এবং পুরস্কার সম-অধিকারের ভিত্তিতে বণ্টন করা হলে বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে। এসব বিষয়ে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রদান করা উচিত। কোনো নাগরিককেই তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।
১০. গণতন্ত্র সুরক্ষা: গণতন্ত্র সুরক্ষার মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিহত করা সম্ভব। কেননা গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার। অধ্যাপক সীলি বলেছেন, "Democracy is a form of government in which everybody has a share." বিশেষ করে ধনিকতন্ত্রে ও অভিজাততন্ত্রে গণতন্ত্রের মেজাজ তৈরি করতে হবে।
১১. আইনের শাসন: আইনের অনুশাসন বিপ্লব নিবারণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য আইনের শাসন কায়েম করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তবেই বিপ্লব প্রতিহত হবে।
১২. দেশাত্মবোধ জাগ্রতকরণ: দেশাত্মবোধ জাগ্রতকরণ বিপ্লব নিবারণের একটি অন্যতম উপায়। জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে। জনগণকে দেশ ও দেশের মাটিকে ভালোবাসতে শিখাতে হবে। দেশের যেকোনো বিপদে তারা অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করবে।তবেই বিপ্লব প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
১৩. সুসম শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন : সুসম শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা বিপ্লবকে প্রতিহত করা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও আদর্শের ভিত্তিতে উত্তম শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এরিস্টটলের মতে, "দেশের নাগরিকদেরকে শাসনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষিথা করে ছলেতে হবে।ত তবেই তারা শাসনব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। ফলে বিপ্লবের আশঙ্কা হ্রাস পাবে।
১৪. দুর্নীতি রোধ: বিপ্লব প্রতিকারের অন্যতম উপায় হলো দুর্নীতি রোধ। কেননা দুর্নীতির ফলে প্রশাসন ভেঙে পড়ে। এ লক্ষ্যে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির মনোভাব পরিহার করতে হবে। তাদের মানবসেবার মন নিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন করতে হবে। তাতে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। বিপ্লবের আশঙ্কা হ্রাস পাবে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্ব তার কালজয়ী একটি ধারণা বা সৃষ্টি। আজ থেকে ২,৫০০ বছর পূর্বে বিপ্লব সম্পর্কে তিনি যে ধারণা দেন তা আজো অনেক রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে বিবেচিত।
এরিস্টটল বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে ও তা প্রতিরোধে গ্রহণীয় যে পরামর্শ দিয়েছেন তা কালের গতিতে মোটেও ম্লান হয় নি। তার এ চিন্তাধারা তাকে বাস্তববাদী দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছে।
লেখকের মন্তব্য
প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আর্টিকেলটিতে বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।বিপ্লব শব্দের ব্যাপ্তি অনেক তাই এই সম্পর্কে জানা খুব জরুরি। দিক বিবেচনা করেই যাচাইকৃত তথ্য দ্বারা এই আর্টিকেলটি লেখা হয়েছে।আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে তার সম্পর্কে আপনি ধারণা পেয়েছেন।যদি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে এটি আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠীদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। যাতে করে তারাও এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
এছাড়াও আরো অন্যান্য আর্টিকেল গুলো যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞানমূলক , চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী,বিভিন্ন আবিষ্কার ও আবিষ্কারক, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আরো অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।
কারণ এ ধরনের আর্টিকেলগুলো আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি।আর এই পোস্ট সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন মতামত কিংবা কোন পরামর্শ থাকে তাহলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে যাবেন। যাতে করে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। আরো অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকে এখানে শেষ করছি ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
পরিশেষে আর্টিকেলটি সম্পন্ন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ💚।
বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url