একনায়কতন্ত্র কাকে বলে

একনায়কতন্ত্রের ইতিহাস অতি প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব সাত ও ছয় শতকে প্রাচীন গ্রিসে স্বৈরাচারতন্ত্রের মধ্যে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাজন অনুযায়ী গণতন্ত্রের বিপরীত সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে একনায়কতন্ত্র।
একনায়কতন্ত্র কাকে বলে

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালি, জার্মানি ও স্পেনে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয় এবং বর্তমানেও এটি অনেক রাষ্ট্রে দেখা যায়। সাধারণত যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।

এ শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রনায়ক হলো একজন। তিনি ক্রমশ নিজে দলের ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষমতাচ্যুত করে নিজ কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যকে দৃঢ় ও নিরঙ্কুশ করেন। এভাবে রাষ্ট্রনায়ক অবাধ ও অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হন।

একনায়কতন্ত্র কাকে বলে

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:

এরিস্টলের মতে, "যখন রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সে যদি নিজের স্বার্থের জন্য শাসন করে তখন তাকে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র বলে।"

রজার ইসক্রটনের মতে, "একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দল সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সকল জনগণের নিকট হতে আনুগত্য আদায় করে।"

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিউম্যান (Newman) বলেছেন, "রাষ্ট্রের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে অবাধে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।"

সুতরাং বলা যায়, একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যা একজনের হাতে ন্যস্ত এবং তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

একনায়কতন্ত্রের আদর্শ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী: একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকার করা হয় না। জনসাধারণকে বলা হয়, To believe, to obey, to fight. এখানে ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোন রকম স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না। জনগণ এখানে অনেকটা নাচের পুতুলের মত।

২. কলপ্রয়োগ: এখানে জনগণের মতামতকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হয়। বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রেই দমন নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

৩. আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব: একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রনায়ক হলো সর্বেসর্বা। তার আদেশই হলো আইন। এ আইন অমান্য করার অধিকার কারও নেই। এখানে নামমাত্র আইন ও বিচার বিভাগ থাকে কিন্তু কোন স্বাধীনতা থাকে না।

৪. মৌলিক অধিকারের অস্বীকৃতি: একনায়কতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহের কোন স্বীকৃতি থাকে না। যেমন- বাকস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমিতির স্বাধীনতা অস্বীকার করা হয়।

৫. উগ্রজাতীয়তাবাদ: একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উগ্রজাতীয়তাবাদের সমর্থক। এতে অন্যজাতি গোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় না।

৬. যুদ্ধ রাজনীতি: একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আলোচনার কোন স্থান নেই। এখানে যুদ্ধ রাজনীতিকে অনুসরণ করা হয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জয়পরাজয় মেনে নেওয়া হয়। এতে বলা হয়, নারীর জন্য মাতৃত্ব আর পুরুষের জন্য যুদ্ধ।

৭. গুপ্তচর বাহিনী গঠন: একনায়ক তার স্থায়িত্বের জন্য ব্যাপক গুপ্তচর বাহিনী গঠন করে। তারা সব ধরনের বিরোধিতার খবর সংগ্রহ করে। যেমন- হিটলারের গেস্টাপো এবং মুসোলিনীর Black shirt বাহিনী।

৮. গোপনীয়তা রক্ষা : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। যেহেতু এক ব্যক্তির একক কর্তৃত্বই বিদ্যমান সেহেতু শাসনব্যবস্থার গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে একনায়কতন্ত্রের অবসানের সম্ভাবনা থাকে।

১. বিপ্লবের সম্ভাবনা: একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তন সাধারণত বিপ্লবের মাধ্যমে হয়ে থাকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন চরম সংকটের মধ্যে পতিত হয়, তখন বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। একনায়কতন্ত্রের বিলুপ্তির বিকল্প থাকে না।

১০. সর্বাত্মক রাষ্ট্র: একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র হলো সর্বাত্মক রাষ্ট্র। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এখানে ব্যক্তির বলে কিছু নেই, সবকিছুই রাষ্ট্রের। মুসোলিনীর মতে, "All within the state none outside the state."

১১. রাষ্ট্র ও সরকার অভিন্ন: একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে অভিন্ন মনে করা হয়। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের মধ্যে অনেকেই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই বলতেন, "I am the state."

১২. একদল, একনেতা: এ শাসনব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। কোন বিরোধী দলের অস্তিত্ব এখানে সহ্য করা হয় না। আর এ একটি দলের একজন নেতা থাকেন। তার নির্দেশিত পথেই সবাইকে চলতে হয়। তার বিরুদ্ধাচারণ করার অধিকার কারও নেই।

১৩. মিথ্যা প্রচারণা: মিথ্যার প্রচারণা একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিজের অত্যাচারী শাসনকে সুন্দর ও জনকল্যাণকর বলে প্রচার করে রাষ্ট্রনায়ক জনগণকে বিভ্রান্ত করে। সকল প্রকার চার মাধ্যমগুলো তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং নিজের মতাদর্শ জোরেসোরে প্রচার করে থাকে।

জার্মানির আইনসভায় আগ্নসংযোগ করে কমিউনিস্টদের উপর মিথ্যা দোষারোপ করে হিটলার কমিউনিস্ট নিধনে আত্মনিয়োগ করলেও মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত জার্মানরা তার কোন প্রতিবাদ করেন নি।

একনায়কতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ

আধুনিক একনায়কতন্ত্রকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা:
১. সামরিক একনায়কতন্ত্র,
২. সাম্রাজ্যবাদী বা সমভোগবাদী বা কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্র এবং
৩. ফ্যাসিবাদী বা নাৎসীবাদী একনায়কতন্ত্র।
তবে একনায়কতন্ত্রের ও শ্রেণীবিভাগের অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যেমন- ফ্যাসীবাদী একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিগত, দলগত বা শ্রেণীগত যে কোনটি হতে পারে।

এ কারণে প্রকৃতিগত বিচারে একনায়কতন্ত্রকে এ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
১. ব্যক্তিগত বা সামরিক একনায়কতন্ত্র, 
২. দলগত একনায়কতন্ত্র, 
৩. শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্র।নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

১. ব্যক্তিগত বা সামরিক একনায়কতন্ত্র (Individual or Military Dictatorship): রাষ্ট্রের যাবতীয় শাসন
একজন ব্যক্তি বা সামরিক নেতার হস্তে একক ও চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত হলে তাকে ব্যক্তিগত বা সামরিক একনায়কতন্ত্র (Military Dictatorship) বলা হয়। এ শাসনব্যবস্থায় মাত্র একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন।

তবে তার পিছনে কোন না কোন রাজনৈতিক দল বা সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সমর্থন থাকে। রোমে জুলিয়াস সিজারের শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত। আর যখন কোন সামরিক নেতা সেনাবাহিনীর সমর্থনে শাসনক্ষমতা দখল করে এবং তাদের সাহায্যেই শাসনকার্য পরিচালনা করে তখন তাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র বলে।

সাধারণত রাষ্ট্রের বৈধ সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে এরূপ একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পাকিস্তানের সেনানায়ক আইয়ুব খান, স্পেনের সেনানায়ক ফ্রাঙ্কো, মিশরের কর্ণেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার জেনারেল সুহার্তো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক রাষ্ট্রে আইনানুমোদিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে একনায়কতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখা যায়।

জার্মানিতে হিটলারের, ইতালিতে মুসোলিনীর, আফ্রিকার ঘানায় নকুমার একনায়কতন্ত্র এ শ্রেণীভুক্ত। সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বিষয়টি মোটামুটি একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।

২. দলগত একনায়কতন্ত্র (Party Dictatorship): যে একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে একটি মাত্র দলের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং অন্য কোন দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, তাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলে। এ শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তি বা দলনেতার সার্বিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় এ ধরনের একনায়কতন্ত্রও ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে নাৎসী দলের একনায়ক হিটলার নাৎসীবাদী একনায়কতন্ত্র এবং ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের নায়ক মুসোলিনী ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁদের এ একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি ছিল দলগত। তাই তাদের শাসনব্যবস্থাকে বলা হতো দলগত একনায়কতন্ত্র।

৩। শ্রেণী ও সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্র (Class Dictatorship): একটি বিশেষ শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকেও একনায়কতন্ত্র বলা হয়। এ শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে থাকে। শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র শ্রেণী শাসন ও শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে।
ধনবৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই ধনিক বণিক শ্রেণীর বা বুর্জোয়া শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার অপরদিকে দেখা যায়, সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র (Dictatorship of the Proletariat) প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এ ধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এরূপ একনায়কতন্ত্রকে সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্র বা সাম্যবাদী দলের একনায়কতন্ত্রও বলা হয়। এরকম একনায়কতন্ত্রেই আদর্শ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রে শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ফলে সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ ধরনের একনায়কতন্ত্র দেশের ও সর্বসাধারণের মজাল সাধন করতে সক্ষম।

একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ

একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলোই একনায়কতন্ত্রের গুণ হিসেবে দেখা হয়। নিম্নে একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ উপস্থাপন করা হলো:

১. যোগ্যতার কদর: একনায়কতন্ত্রে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা যোগ্যতার বিচারে সরকারি আনুকূল্য লাভ করেন। ফলে জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়।

২. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গণতন্ত্রে বহু রাজনৈতিক দল থাকে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে দলাদলি বা দলীয় বিরোধ নেই। সেজন্য জাতীয় সংহতি ও ঐক্যবোধ দৃঢ় হয়।

৩. জাতীয়তাবাদের সুফল: একনায়কতন্ত্রে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পায়। দেশ, জাতি ও নায়কের শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশপ্রেম বৃদ্ধি পায়। ফলে সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথ সুগম হয়।

৪. শিক্ষা সাহিত্যের উন্নতি: একনায়কতন্ত্রে দেশবাসীর শিক্ষা সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং এসব ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি উৎকর্ষ সুনিশ্চিত হয়।

৫. বহুদলীয় শাসনের ত্রুটিমুক্ত গণতন্ত্রে বহুদলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ হেতু সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মকুশলতা হ্রাস পায়। একনায়কতন্ত্র এ দোষ থেকে মুক্ত। একনায়কতন্ত্রে বহুদলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না।

৬. জরুরি অবস্থায় উপযোগী: একনায়কতন্ত্র জরুরি অবস্থায় উপযোগী। একনায়কতন্ত্রে সকল ক্ষমতা নায়কের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ফলে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সম্পন্ন একনায়ক এককভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।

৭,স্বায়িত্বঃসরকারের স্থায়িত্ব একনায়কতন্ত্রের এক বিশেষ গুণ। গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তন, দলত্যাগ প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন নির্বাচন ও সরকারের পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। ফলে জনকল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।

৮. দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। একনায়কতন্ত্রে নায়ক চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

৯. দক্ষ শাসন। একনায়কতন্ত্রে দক্ষ শাসন বর্তমান। এক্ষেত্রে সুযোগ্য ও সুদক্ষ নায়কের নির্দেশে দেশের সমস্যাদির দ্রুত সমাধান ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব হয়।

১০. ব্যয় সংকোচন। একনায়কতন্ত্রে একজন মাত্র শাসকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় প্রশাসনিক ব্যয় কম হয়। এতে অহেতুক ব্যয় পরিহার করা হয়।

১১. আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য রোধ। এ শাসনব্যবস্থায় শাসক যেহেতু দক্ষ ও অভিজ্ঞ, সেহেতু এখানে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্মা রোধ করা সহজ হয়।

১২. সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন। একনায়কতন্ত্রে শাসক অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়। ফলে একনায়ক দেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন।

১৩. সরকারি নিয়ন্ত্রণ। একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নায়ক ও তার অনুসারী দলের আদর্শের নিচে জনজীবনের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ন্যায় নীতি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশংকা থাকে না।

১৪. প্রগতিশীল। একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে উত্তম গুণ হলো এ শাসনব্যবস্থা একটি প্রগতিশীল শাসনধাবস্থা। এ শাসনব্যবস্থায় দক্ষ ও শিক্ষিত এবং বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক শাসনকার্য পরিচালিত হয় এজন্য খুব সহজেই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ফলে এটি সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা।

একনায়কতন্ত্রের অসুবিধাসমূহ বা দোষসমূহ

একনায়কতন্ত্রের কতকগুলো ত্রুটি বা দোষ বা অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। এসব ত্রুটিসমূহ নিম্নরূপ:

১. যুদ্ধবাজ মতবাদ: একনায়কতন্ত্রে যুদ্ধকে প্রশ্রয় দেয়। একনায়কতন্ত্র পশুশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর যুদ্ধবাজের ফলে জীবনের সকল শান্তি বিনষ্ট হয়।

২. বিপ্লবের আশংকা অধিক: এ শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের আশংকা সর্বদা বর্তমান থাকে। এখানে জনগণের সুখদুঃখ ও অভাব অভিযোগ প্রকাশ করার সুযোগ নেই। ফলে শাসন পরিবর্তনের জন্য জনগণ বাধ্য হয়ে বিপ্লবের পথ গ্রহণ করে।

৩. স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেই: এ শাসনব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেই। ফলে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে জনগণ উদাসীন থাকে। ব্যানারম্যান বলেছেন, Better bad government under self-government than good government under dictatorship.

৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী: একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি। এ শাসনব্যবস্থায় শাসকই চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন। জনগণের স্বাধীনতা অস্বীকৃত। জনগণকে কেবল বলা হয়, "বিশ্বাস কর, মান্য কর, যুদ্ধ কর।"

৫. ব্যক্তি উপেক্ষিত: একনায়কতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ রাষ্ট্র গঠনের উপাদান মাত্র। রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তির কোন স্বাতন্ত্র্য নেই।

৬. পশুশক্তির উপর নির্ভরশীল পশুশক্তি ও হিংসা হলো একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি। বলপ্রয়োগ ও শক্তির জোরে একনায়ক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এবং একই পথে তিনি তা-বহাল রাখতে উদ্যোগী হন।

৭. রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ নেই: একনায়কতন্ত্রে নায়কের দল ছাড়া অন্য কোন দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। এমতাবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামত জানার, ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ জনগণ পায় না। ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে না।

৮. বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে অনুপযোগী বৃহদায়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কারণ একনায়কের পক্ষে বিশালাকার দেশের সকল সমস্যার প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব হয় না।

৯. মানবতার অপমান এ শাসনব্যবস্থায় যাবতীয় মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা হয়। পুলিশ, গুপ্তচর বাহিনী ও সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে অবাধে দমন পীড়ন চালাতে থাকে। ফলে মানবতার নীতি অসহায়ভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়।

১০. সরকারি অর্থের অপচয়: এ শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের আশংকা থাকায় একনায়ককে বিশাল গুপ্তচর বাহিনী ও বৃহৎ সেনাবাহিনী গঠন করতে হয়। এসব খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।

১১. সাম্য বিরোধী: এ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সাম্যনীতি অস্বীকৃত এবং শাসকের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেণী বিশেষের কর্তৃত্ব স্বীকৃত। শাসক সবরকম ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে। হিটলারের জার্মানি ও মুসোলিনীর ইতালিতে এ ধারণা প্রচলিত ছিল।

১২. যোগ্য নায়ক সবসময় পাওয়া যায় না: একনায়তকান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোন যোগ্য, বিজ্ঞ ও দক্ষ নায়কের শাসনাধীনে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হতে পারে। কিন্তু দক্ষ শাসক হিসেবে সবসময় যোগ্য নায়ক পাওয়া যায় না।

১৩. আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন একনায়কতন্ত্রে একনায়কই হলো সর্বেসর্বা। তার উপর কোন কথা

বলা চলে না। তার নির্দেশই আইন। এ নির্দেশ অমান্য বা এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অধিকার কারও নেই। এ শাসনব্যবস্থায় নামেমাত্র একটি আইন ও বিচার বিভাগ থাকে। এর কোন স্বাধীন ক্ষমতা থাকে না।

১৪. মিথ্যা প্রচার: মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমেই একনায়কতন্ত্রের শাসন পরিচালিত হয়। বেশিরভাগ সময়ই শাসন

জনগণকে বিভ্রান্তির কবলে ফেলে দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। এ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অনেকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অন্ত বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা হিসেবে সমর্থন করেন। তাদের বক্তব্য হলো, যখন কোন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন নতুন সমাজব্যবস্থার অনুকূল পরিবেশ রচনার জন্য এটি আবশ্যক।

তবে এ মতবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী এবং যুদ্ধবাজনীতিতে বিশ্বাসী। এ মতবাদকে বিংশ শতাব্দীর উন্নত সমাজ সংস্কৃতির যুগে সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না।

লেখকের মন্তব্যঃ

আশা করি উপরোক্ত আর্টিকেলটি পড়ে একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা অর্জন করেছেন। আর এই ধারণা আপনি আপনার ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন। আর যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে তা আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে কিংবা সহকারীদের সাথে শেয়ার করতে পারেন যাতে করে তারাও এ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে।

আর এ ধরনের আরো আর্টিকেল যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক সাধারণ জ্ঞান জাতীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ে লিখা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটটিতে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।
পরিশেষে আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url