গণতন্ত্রের কাকে বলে
অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Prof. MacIver) বলেছেন, "গণতন্ত্র বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠের বা অন্য কারও দ্বারা শাসনকার্য পরিচালিত হওয়ার পদ্ধতিকে বুঝায় না, বরং এটা কে বা কারা করবে এবং মোটামুটিভাবে কোন উদ্দেশ্যে শাসন করবে, তা নির্ধারণ করারই উপায় বিশেষ।" নিম্নে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো
সাধারণভাবে বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা এক বা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ন্যস্ত না থেকে সমগ্র জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং অধিকাংশ জনগণকে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয় তাকে গণতন্ত্র বলে।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Democracy'। শব্দটি এসেছে 'Demos' ও 'Kratos' দু'টি গ্রিক শব্দ হতে। এ শব্দ দু'টির অর্থ যথাক্রমে 'জনগণ' এবং 'শাসন' বা 'কর্তৃত্ব'। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন।
১. প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার: বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে বোঝায়। সুতরাং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন গণতন্ত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো বৃহদায়তন বিশিষ্ট এবং জনসংখ্যা ব্যাপক।
২. প্রতিনিধি নির্বাচন: প্রতিনিধি নির্বাচনকে জনগণ একটি উৎসবের মতো মনে করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অর্থাৎ জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে।
৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন: গণতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় যে কোন কারণেই হোক সকলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। তাছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সকলেই শাসনকার্য পরিচালনা করার সুযোগ পান না।
৪. সর্বসাধারণের স্বার্থে গণতন্ত্রঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর ন্যস্ত থাকলেও সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত ও স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না এমনটি নয়। সার্বিকভাবে সর্বসাধারণের স্বার্থ ও কল্যাণার্থে শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
৫. জনগণের সম্মতি : সর্বসাধারণের সম্মতি ব্যতিত গণতন্ত্র অচল। রাষ্ট্রের সংখ্যালঘিষ্ঠ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ উভয় দলই গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। কারণ সর্বসাধারণের স্বার্থেই গণতান্ত্রিক সরকার কাজ করে। তাই একে জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার বলে।
৬. জনমতের প্রাধান্য: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনমতের প্রাধান্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রে জনমতকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। জনমতের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। জনমত হলো গণতন্ত্রের আত্মাস্বরূপ। আত্মা ছাড়া মানুষ বাঁচে না তেমনি জনমত ব্যতীত সরকার টিকে থাকতে পারে না।
৮. রাজনৈতিক সাম্য: রাজনৈতিক সাম্য বলতে শাসনকার্যে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সুবিধাকে বোঝায় এই রাজনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন করা বা নির্বাচি হওয়ার ব্যাপারে সকলেই সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করে।
ক. প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র (Direct Democracy) এবং
খ. পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (Indirect Democracy) ।
১. স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বই গণতন্ত্রের ভিত্তি: স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এ স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি।
২. দেশপ্রেমের সৃষ্টি: সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। তাই সরকারকে তাদের নিজেদের সরকার হিসেবে ভাবতে শেখে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি সৃষ্টি হয়।
৩. আইনের শাসন: গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল ক্ষেত্রে জনগণই চূড়ান্ত বিচারক। ফলে সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণের পথ রুদ্ধ থাকে।
৪. হিতবাদী 'তত্ত্বের সমাধান: হিতবাদী তত্ত্বে বলা হয়, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ মৌলিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। হিতবাদী জেমস মিল বলেছেন, গণতন্ত্র হলো বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবন।
৫. আদর্শবাদের সমর্থন: আদর্শবাদী তত্ত্বে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি ও সমাধান পাওয়া যায়। আদর্শবাদে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে ব্যক্তি আত্মত্মবিকাশের সর্বাধিক সুযোগ লাভ করে।
৬. ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা: গণতন্ত্র হলো ন্যায়নীতিভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ ব্যবস্থায় সকলের সাথে মতামতের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং সাম্য ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়।
৭. সর্বসাধারণের কল্যাণ: গণতন্ত্রেই সকল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। এইচ. লাস্কি বলেছেন,জনকল্যাণ সাধন যদি সরকারের লক্ষ্য হয় তবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতেই থাকা আবশ্যক। তাই গণতন্ত্রে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল বিধানের জন্য সরকারি ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়।
৮. স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন সম্ভব। আর গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: গণতন্ত্রে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
১১. স্থায়িত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের পিছনে জনগণের ব্যাপক সম্মতি বর্তমান থাকে। সে জন্য গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়। স্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার সুশাসন নিশ্চিত করে।
১২. স্বৈরাচারিতা রোধ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হলো জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনমতের ভয়ে সরকার সাধারণত স্বৈরাচারী হতে পারে না।
১৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। উপযোগবাদী তাত্ত্বিক জেমস মিল, জেরিমি ব্যোম প্রমুখ গণতন্ত্রের সমর্থকরা বলেন, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা সকলেই ভোগ করার সুযোগ পায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার
১. পুঁজিবাদের ত্রুটি: গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিত্তবান পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয়।
২. আমলাতন্ত্রের ত্রুটি: গণতন্ত্রে জন প্রতিনিধিদের সুষ্ঠু শাসনকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে তারা আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর আমলাদের প্রাধান্য-প্রতিপত্তির জন্য জনসাধারণের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৩. অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শাসন: গণতন্ত্র অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। কারণ গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন এবং জনগণের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। লেকি বলেছেন, গণতন্ত্র হলো সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ এবং সর্বাপেক্ষা অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা।
৪. ব্যয়বহুল: অনেকের মতে, গণতন্ত্র হলো একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত যাচাই, ব্যাপক প্রচারকার্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সরকার প্রচুর অর্থের অপচয় করে।
৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থের অবহেলা: গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। তাই সংখ্যালঘুরা আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৬. সততা ও যোগ্যতার কদর নেই: যে কোন শাসনব্যবস্থার সাফল্য শাসকবর্গের বুদ্ধিমত্তা ও গুণগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
৭. রক্ষণশীল: গণতন্ত্র অশিক্ষিত ও অজ্ঞ ব্যক্তির শাসন। তাই এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগত শাসন। এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রগতি বিরোধী ও রক্ষণশীল। F. W. Coker মন্তব্য করেছেন- Democracies are the most conservative of all forms of state.
৮. দল প্রথার কুফল: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। গণতন্ত্রে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সে দলই সরকার গঠন করে। ফলে কার্যত দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি দল প্রায় ক্ষেত্রেই বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।
১.ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর গণতন্ত্রে বহু পরস্পর বিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোন স্থায়ী সরকার গঠন করা যায় না। হেনরি মেইনের মতে, স্থায়িত্বের অভাব গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ত্রুটি।
১০. জরুরি অবস্থার অনুপযোগী বহিরাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু গণতন্ত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয় বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়।
১১. নৈতিকতার অবনতি: গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হলো অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। এ অবস্থায় চতুর ও স্বার্থপর কিছু নেতা মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হয়। ফলে নৈতিকতার চরম অবনতি ঘটে।
১২. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার: সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়। এ ধরনের সরকার অনেক সময় স্বৈরাচারী হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gettell) মন্তব্য করেন যে, "গণতান্ত্রিক সরকারের পিছনে ব্যাপক ক্ষমতা থাকায় সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক সরকারে পরিণত হতে পারে।"
১৩. দলীয় স্বার্থরক্ষা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সে দলই সরকার গঠন করে। তাদের কঠোর দলীয় নিয়ন্ত্রণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনুগত করে তোলে। ফলে তারা নিজ দলের স্বার্থরক্ষা করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করে।
ভূমিকা
গণতন্ত্র আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে সমাদৃত শাসনব্যবস্থা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিস দেশে সর্বপ্রথম 'গণতন্ত্র' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সে সুদূর অতীতকাল থেকে আজ পর্যন্ত নতুন ধ্যানধারণা একে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা আরও জটিল রূপ গ্রহণ করেছে।এ কারণে Mobbott মন্তব্য করেছেন যে, "Democracy is the most elusive and ambiguous of all political terms." তবুও আধুনিক বিশ্বে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে গণতন্ত্রের স্থান সর্বোচ্চে। গোটা বিশ্ব আজ গণতন্ত্রের জয়গানে মুখর। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে গণতন্ত্র মানুষকে মর্যাদা ও গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে।
সাধারণভাবে বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা এক বা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ন্যস্ত না থেকে সমগ্র জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং অধিকাংশ জনগণকে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয় তাকে গণতন্ত্র বলে।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Democracy'। শব্দটি এসেছে 'Demos' ও 'Kratos' দু'টি গ্রিক শব্দ হতে। এ শব্দ দু'টির অর্থ যথাক্রমে 'জনগণ' এবং 'শাসন' বা 'কর্তৃত্ব'। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন।
গণতন্ত্রের কাকে বলে
গণতন্ত্র হচ্ছে সে শাসন ব্যবস্থা যেখানে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত হয় জনমত দ্বারা।আরো পড়ুনঃ সমাজ কাকে বলে ও এর বৈশিষ্ট্য
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচোনা কর
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এই প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নে গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:১. প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার: বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে বোঝায়। সুতরাং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন গণতন্ত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো বৃহদায়তন বিশিষ্ট এবং জনসংখ্যা ব্যাপক।
এ কারণে সর্বসাধারণের সরাসরি মতামত গ্রহণপূর্বক শাসনকার্য পরিচালনার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই বর্তমানে প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ বিপ্লব বলতে কি বুঝায়
২. প্রতিনিধি নির্বাচন: প্রতিনিধি নির্বাচনকে জনগণ একটি উৎসবের মতো মনে করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অর্থাৎ জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে।
৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন: গণতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় যে কোন কারণেই হোক সকলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। তাছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সকলেই শাসনকার্য পরিচালনা করার সুযোগ পান না।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের মধ্যে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সে দলের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠিত ও দেশ পরিচালিত হয়। সুতরাং গণতন্ত্র জনগণের সমগ্র অংশের নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠেরও নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শাসন মাত্র।
৪. সর্বসাধারণের স্বার্থে গণতন্ত্রঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর ন্যস্ত থাকলেও সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত ও স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না এমনটি নয়। সার্বিকভাবে সর্বসাধারণের স্বার্থ ও কল্যাণার্থে শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
৫. জনগণের সম্মতি : সর্বসাধারণের সম্মতি ব্যতিত গণতন্ত্র অচল। রাষ্ট্রের সংখ্যালঘিষ্ঠ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ উভয় দলই গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। কারণ সর্বসাধারণের স্বার্থেই গণতান্ত্রিক সরকার কাজ করে। তাই একে জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার বলে।
৬. জনমতের প্রাধান্য: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনমতের প্রাধান্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রে জনমতকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। জনমতের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। জনমত হলো গণতন্ত্রের আত্মাস্বরূপ। আত্মা ছাড়া মানুষ বাঁচে না তেমনি জনমত ব্যতীত সরকার টিকে থাকতে পারে না।
৭. গণসার্বভৌমত্ব : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণসার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ জনগণের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। জনগণ তাদের ইচ্ছামতো এ নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে এ ক্ষমতা ব্যবহার করে।
৮. রাজনৈতিক সাম্য: রাজনৈতিক সাম্য বলতে শাসনকার্যে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সুবিধাকে বোঝায় এই রাজনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন করা বা নির্বাচি হওয়ার ব্যাপারে সকলেই সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করে।
এখানে ধনগত, জন্মগত, বর্ণগত, ধর্ম প্রভৃতি বৈষম্যকে স্বীকন করা হয় না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দিক থেকে সকলেই সমান ক্ষমতার অধিকারী।
গণতান্ত্রিক কত প্রকার ও কি কি
গণতন্ত্র অর্থ জনগণের সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে জনগণ সরাসরি অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। এর উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রকে দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা:ক. প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র (Direct Democracy) এবং
খ. পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (Indirect Democracy) ।
আরো পড়ুনঃ জাতীয়তা কাকে বলে
প্রত্যক্ষ কাকে বলে
যে সরকার ব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি নিজেরাই দেশের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করে তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে। এ রকম শাসনব্যবস্থায় জনগণই সরকারি যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। প্রাচীনকালে গ্রিস দেশের নগররাষ্ট্রসমূহে (City States) এ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল
এ ব্যবস্থায় নাগরিকগণ নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্ধারিত স্থানে মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন, সরকারি কর্মচারী নিয়োগ, রাজস্ব ও ব্যয় নির্ধারণ প্রভৃতি এবং সরকারি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এভাবে জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাই হলো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সকল নাগরিকই সরাসরি রাষ্ট্রীয়কার্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। তাই এ শাসনব্যবস্থাকে অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্র (Participatory Democracy) বলা হয়। নাগরিকগণ আইন প্রণয়ন ও শাসন সংক্রান্ত অন্যান্য কাজ করার জন্য যে স্থানে মিলিত হতো এথেন্সে একে বলা হতো 'এক্লেসিয়া' (Ecclecsia) আর রোমে বলা হতো 'মিলিশিয়া' (Militia)।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র শুধুমাত্র ক্ষুদ্রায়তন ও সংখ্যালঘু রাষ্ট্রেই সম্ভব। প্রাচীন গ্রিসে, রোমে, ভারতবর্ষে নগররাষ্ট্র ছিল। কারণ এ নগররাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট ও স্বল্প জনসংখ্যা সমন্বিত। তাই নগররাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার ব্যাপারে কোন প্রকার অসুবিধা ছিল না।
সেই সময় সমস্যার পরিমাণ ছিল কম এবং সহজ সরল প্রকৃতির। এ কারণে স্বল্পসংখ্যক নাগরিক সহজে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ সময়ে একত্রিত হয়ে সমস্যাদির সমাধান করে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে সক্ষম হতো
পরোক্ষ গণতন্ত্র কাকে বলে
বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই পরোক্ষ গণতন্ত্র চালু রয়েছে। এ শাসনব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে এবং এ নির্বাচিত প্রতিনিধির উপরই শাসনব্যবস্থা বা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে।অর্থাৎ জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরোক্ষভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এরূপ শাসনব্যবস্থাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন বা সরকার পরিচালিত হয় বলে একে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রও (Representative Democracy) বলা হয়।
পরোক্ষ গণতন্ত্র সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিল (J.S. Mill) বলেছেন, "It is a form of government where the whole people or some numbers portion of them exercise the governing power though deputies periodically elected by themselves.
"১২ অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণের সমগ্র অংশ বা অধিকাংশ নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা ব্যবহার করে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের কর্তব্য বা কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় সরকারের আইন ও শাসন বিভাগ সবসময় জনমতের পক্ষে কাজ করে থাকে। পরোক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাই হলো জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র। বৃহদায়তন ও জনবহুল রাষ্ট্রে পরোক্ষ গণতন্ত্রই বিশেষ উপযোগী এবং কাম্য।
তবে অনেক সময় দেখা যায়, জনগণের নির্বাচিত সরকার জনগণের ইচ্ছা বা মতামতকে উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো শাসনকার্য পরিচালনা করে। এতে সরকারের অনেক কার্যাবলি জনমতের বিরোধী হয় এবং দেখা দেয় বিদ্রোহ ও বিপ্লব। নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হওয়াই পরোক্ষ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অসুবিধা।
পরোক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাই হলো জনসাধারণ (People) এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের (Elected representative) মধ্যে প্রধান যোগসূত্র। বৃহৎ ও জনবহুল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরোক্ষ গণতন্ত্রই হলো উপযোগী শাসনব্যবস্থা।
গণতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ
আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থায় কতকগুলো গুণ পরিলক্ষিত হয়। গুণসমূহ নিম্নরূপ:১. স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বই গণতন্ত্রের ভিত্তি: স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এ স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি।
এ ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার শুভাশুভ নির্ধারণের সুযোগ পায়। লাওয়েল (Lowell) বলেছেন, "In a complete democracy no one can complain that he has not a curse to be heard." গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে এবং সকলের স্বার্থ
২. দেশপ্রেমের সৃষ্টি: সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। তাই সরকারকে তাদের নিজেদের সরকার হিসেবে ভাবতে শেখে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি সৃষ্টি হয়।
৩. আইনের শাসন: গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল ক্ষেত্রে জনগণই চূড়ান্ত বিচারক। ফলে সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণের পথ রুদ্ধ থাকে।
৪. হিতবাদী 'তত্ত্বের সমাধান: হিতবাদী তত্ত্বে বলা হয়, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ মৌলিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। হিতবাদী জেমস মিল বলেছেন, গণতন্ত্র হলো বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবন।
৫. আদর্শবাদের সমর্থন: আদর্শবাদী তত্ত্বে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি ও সমাধান পাওয়া যায়। আদর্শবাদে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে ব্যক্তি আত্মত্মবিকাশের সর্বাধিক সুযোগ লাভ করে।
৬. ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা: গণতন্ত্র হলো ন্যায়নীতিভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ ব্যবস্থায় সকলের সাথে মতামতের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং সাম্য ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়।
৭. সর্বসাধারণের কল্যাণ: গণতন্ত্রেই সকল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। এইচ. লাস্কি বলেছেন,জনকল্যাণ সাধন যদি সরকারের লক্ষ্য হয় তবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতেই থাকা আবশ্যক। তাই গণতন্ত্রে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল বিধানের জন্য সরকারি ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়।
৮. স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন সম্ভব। আর গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: গণতন্ত্রে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এতে জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ঘটে। জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়।
১০. দায়িত্বশীলতা: গণতন্ত্রে শাসিতের কাছে শাসক দায়িত্বশীল থাকে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ জনগণের কাছে দায়ী থাকে। আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
১১. স্থায়িত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের পিছনে জনগণের ব্যাপক সম্মতি বর্তমান থাকে। সে জন্য গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়। স্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার সুশাসন নিশ্চিত করে।
১২. স্বৈরাচারিতা রোধ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হলো জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনমতের ভয়ে সরকার সাধারণত স্বৈরাচারী হতে পারে না।
১৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। উপযোগবাদী তাত্ত্বিক জেমস মিল, জেরিমি ব্যোম প্রমুখ গণতন্ত্রের সমর্থকরা বলেন, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা সকলেই ভোগ করার সুযোগ পায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দোষ বা অসুবিধাসমূহ
বিভিন্ন গুণাবলির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার অভাব নেই। সমালোচকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা বা ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ নিম্নরূপ:১. পুঁজিবাদের ত্রুটি: গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিত্তবান পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয়।
২. আমলাতন্ত্রের ত্রুটি: গণতন্ত্রে জন প্রতিনিধিদের সুষ্ঠু শাসনকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে তারা আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর আমলাদের প্রাধান্য-প্রতিপত্তির জন্য জনসাধারণের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৩. অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শাসন: গণতন্ত্র অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। কারণ গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন এবং জনগণের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। লেকি বলেছেন, গণতন্ত্র হলো সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ এবং সর্বাপেক্ষা অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা।
৪. ব্যয়বহুল: অনেকের মতে, গণতন্ত্র হলো একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত যাচাই, ব্যাপক প্রচারকার্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সরকার প্রচুর অর্থের অপচয় করে।
৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থের অবহেলা: গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। তাই সংখ্যালঘুরা আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৬. সততা ও যোগ্যতার কদর নেই: যে কোন শাসনব্যবস্থার সাফল্য শাসকবর্গের বুদ্ধিমত্তা ও গুণগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
৭. রক্ষণশীল: গণতন্ত্র অশিক্ষিত ও অজ্ঞ ব্যক্তির শাসন। তাই এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগত শাসন। এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রগতি বিরোধী ও রক্ষণশীল। F. W. Coker মন্তব্য করেছেন- Democracies are the most conservative of all forms of state.
৮. দল প্রথার কুফল: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। গণতন্ত্রে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সে দলই সরকার গঠন করে। ফলে কার্যত দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি দল প্রায় ক্ষেত্রেই বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।
১.ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর গণতন্ত্রে বহু পরস্পর বিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোন স্থায়ী সরকার গঠন করা যায় না। হেনরি মেইনের মতে, স্থায়িত্বের অভাব গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ত্রুটি।
১০. জরুরি অবস্থার অনুপযোগী বহিরাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু গণতন্ত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয় বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়।
১১. নৈতিকতার অবনতি: গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হলো অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। এ অবস্থায় চতুর ও স্বার্থপর কিছু নেতা মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হয়। ফলে নৈতিকতার চরম অবনতি ঘটে।
১২. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার: সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়। এ ধরনের সরকার অনেক সময় স্বৈরাচারী হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gettell) মন্তব্য করেন যে, "গণতান্ত্রিক সরকারের পিছনে ব্যাপক ক্ষমতা থাকায় সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক সরকারে পরিণত হতে পারে।"
১৩. দলীয় স্বার্থরক্ষা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সে দলই সরকার গঠন করে। তাদের কঠোর দলীয় নিয়ন্ত্রণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনুগত করে তোলে। ফলে তারা নিজ দলের স্বার্থরক্ষা করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করে।
বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url